খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মতো ভোটের দিন গাজীপুরে কর্মীশূন্য থাকতে চায় না বিএনপি। সেই সঙ্গে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে এজেন্ট উপস্থিতিও নিশ্চিত করতেও উদ্যোগী হয়েছে তারা।
দলটির মতে, খুলনায় যেসব কেন্দ্র সরকারি দল ‘কারচুপি’ করতে পেরেছে, তার কারণ ছিল তাদের কর্মী স্বল্পতা আর এজেন্ট না থাকা।
এই দুটি বিষয়য়ে খুলনা সিটি নির্বাচনে ‘ভুল’ হিসেবে দেখছেন বিএনপির নেতারা। আর গাজীপুরে এই ভুলের পুনরাবৃত্তি যেন কোনোভাবেই না হয়, সে জন্য আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।
দলের প্রার্থী হাসানউদ্দিন সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতারা গত সোমবার বসে এই কৌশল নির্ধারণ করেছেন।
গত ১৫ মে খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু ৬৮ হাজার ভোটে হেরেছেন। তবে বিএনপির অভিযোগ তাদেরকে হারানো হয়েছে ‘ভোট ডাকাতি’ করে। ২৮৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ১০৫টিকে কারচুপির বা জালভোটের অভিযোগ এনেছেন মঞ্জু।
খুলনায় ২৮৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ৩০টিতে বিএনপির পোলিং এজেন্ট ছিলো না বলে জানিয়েছেন দলের প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু। তার দাবি, সরকারি দলের প্রার্থীর লোকজন তাদের বের করে দিয়েছে।
খুলনায় যেদিন ভোট হওয়ার কথা ছিল, সেদিন ভোট হওয়ার কথা ছিল গাজীপুরেও। কিন্তু ৬ মে হাইকোর্টে সাভারের শিমুলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এ বি এম আজহারুল ইসলাম সুরুজের এক আবেদনের কারণে নির্বাচন ঝুলে যায়।
১০ মে আপিল বিভাগ স্থগিতাদেশ তুলে দিলেও রোজায় ভোট নিতে চায়নি নির্বাচন কমিশন। ভোটের নতুন তারিখ ঠিক হয়েছে ২৬ জুন। আর ১৮ জুন থেকে শুরু করা যাবে স্থগিত হওয়া প্রচার।
বিএনপি নেতারা বলছেন, ভোটের প্রচার শুরু হওয়ার আগেই গাজীপুরে ওয়ার্ডভিত্তিক নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করে। স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে হবে বিশেষ দল। এর বাইরে শীর্ষ নেতাদের নিয়ে হবে আলাদা দল।
গাজীপুরে ভোটের আগের রাতে কেন্দ্র পাহারা, ভোটের দিনে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি রাখা, ভোটকেন্দ্রে পোলিং এজেন্ডা নিশ্চিত করা হবে।
মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার এবং গাজীপুরের নেতারা কেন্দ্রীয় নেতাদের আশ্বস্ত করেছেন তারা ভোটের দিন ময়দান ছেড়ে যাবেন না।
বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে চার ঘণ্টার ওই বৈঠকে ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ঢাকা বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি ফজলুল হক মিলন, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদ, শহিদুল ইসলাম বাবুল, গাজীপুর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সোহরাব উদ্দিন এবং গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৫৭টি ওয়ার্ডের নেতারা।
বৈঠকে অংশ নেয়া একজন কেন্দ্রীয় নেতা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘খুলনায় ভোটের দিনে দলের নেতাকর্মীরা নিজেদের মত করে ভোট দিলেও মাঠে তেমন সেইভাবে উপস্থিত ছিলেন না। যে কারণে সরকার দলীয় প্রার্থীর লোকজন কারচুপি করার সুযোগ পেয়েছে।’
‘গাজীপুরে আমরা সেই সুযোগ দিতে রাজি না। সেইভাবে পরিকল্পনা করা হচ্ছে।’
১৫ এপ্রিল খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট শেষে আওয়ামী লীগের বিজয়ী প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেকও বিএনপি কর্মীদের ‘অনুপস্থিতি’ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বলেন, ‘সারাদিন তো তাদেরকে দেখলামই না।’
গাজীপুর নির্বাচন নিয়ে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে বৈঠক শেষে বিএনপির ওই নেতা আরও বলেন, ‘হাসান উদ্দিন সরকার শীর্ষ নেতাদের আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, তিনি বেঁচে থাকতে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ভোট কারচুপি হতে দেবেন না। কারচুপি মোকাবেলার দায়িত্ব তার।’
বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ১৮ জুন প্রচার শুরুর দিন থেকেই থেকে ওয়ার্ডভিত্তিক বিএনপির নির্বাচন পরিচালনা কমিটি কাজ শুরু করবে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় প্রয়োজনে বিশেষ দল কাজ করবে।
ভোটে বিদেশি পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যম চাওয়া হবে। আগের রাত থেকেই কেন্দ্র পাহারা দেওয়া হবে।
প্রতিটি বুথেই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এজেন্ট উপস্থিতি নিশ্চিত করা হবে। একইসঙ্গে মামলা নেই এমন নেতাকর্মীদের পোলিং এজেন্ড নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
জানতে চাইলে গাজীপুর নির্বাচনে বিএনপির কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির প্রধান খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মিডিয়ার কল্যাণে সবার কাছে পরিষ্কার হয়েছে কীভাবে সরকার খুলনায় নির্বাচন করে দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করেছে। বাইরের পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ রেখে ভেতরে ভেতরে কারচুপি করেছে। এটা নতুন কৌশল। আমরা রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে কাজ করব।’
গাজীপুর বিএনপির সভাপতি ফজলুল হক মিলন বলেন ‘খুলনা নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা গাজীপুরের ব্যাপারে করণীয় চিন্তা করছি। নেতাকর্মীরা ভোটের দিন শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকবে।’
পোলিং এজেন্ট নিয়োগের ব্যাপারে মিলন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো মামলা নেই তাদেরই পোলিং এজেন্ট করা হবে। যাতে তারা সাহসের সঙ্গে ভোটের দিন শেষ পর্যন্ত থাকে সেজন্যও কাজ চলছে।’
তবে জানতে চাইলে মেয়র হাসান উদ্দিন সরকার শুরুতে তাদের ‘কৌশলের’ বিষয়ে কিছু বলতে চাননি। তিনি বলেন, ‘আমরা গাজীপুরে জয়ী হওয়ার নিশ্চয় কৌশল নির্ধারণ করব। কিন্তু আপনারা জেনে গেলে সেটা কি আমাদের জন্য ভালো হবে?’
পরে অবশ্য হাসান বলেন, ‘খুলনায় আমাদের যে ভুল হয়েছে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সেটা গাজীপুরে না হোক।’
‘খুলনা আর গাজীপুরের পরিবেশ কিন্তু এক না। এটা মাথায় রাখতে হবে। এটা অনেক বড় সিটি করপোরেশন। এক প্রান্তে কিছু ঘটলে খবর পেলে যে কোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটে যেতে পারে।’
খুলনায় কোন ভুলের কথা বলছিলেন জানতে চাইলে বিএনপির মেয়র প্রার্থী বলেন, ‘যেমন সময়মত আমাদের এজেন্টরা কেন্দ্রে যেতে পারেনি। এখানে আমরা সেটা পুরোপুরি নিশ্চিত করব। আবার খুলনায় অনেক কেন্দ্র থেকে আমাদের এজেন্ট বের করে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এখানে আমরা শেষ পর্যন্ত বাধা বিপত্তি আসলেও কেন্দ্রে থাকব। কারণ না থাকলেই অনেক ঘটনা ঘটে যাবে।’
গাজীপুরে সাত জন মেয়র প্রার্থী রয়েছেন। তবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ধানের শীষের হাসানের সঙ্গে আছেন নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের জাহাঙ্গীর আলম।
আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় সিটি করপোরেশনটিতে ওয়ার্ড সংখ্যা মোট ৫৭টি। আর এবার ভোটার সংখ্যা ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৬জন।
২০১৩ সালের মেয়র নির্বাচনে গাজীপুরে থেকে জিতেছিলেন বিএনপি নেতা এম এ মান্নান। তবে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে হতে যাওয়া নির্বাচনে তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি।