খাইরুল ইসলাম, ঝালকাঠি প্রতিনিধি:
বর্ষা মৌসুম। অঝোড়ে ঝড়ছে শ্রাবণ ধারা। সেই সাথে বাড়ছে নদী-খালের পানিও। সর্বত্রই থৈ থৈ করছে পানি। আর এ মৌসুম এলেই ঝালকাঠি সদর উপজেলার ৩ ইউনিয়নের বাসিন্দাদের জিবীকা অর্জনের অন্যতম বাহন নৌকা। তবে সে নৌকা নয় বড় কোন মালবাহী নৌকা, সেটি হচ্ছে ডিঙি নৌকা। একদিকে নৌকা বানিয়ে বিক্রি। অপরদিকে যাতায়াত ও উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য ব্যবহার করা হয় এই নৌকা। ঝালকাঠি সদর উপজেলার কির্ত্তীপাশা, নবগ্রাম ও গাভারামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের চিত্র এটি।
তবে ঝালকাঠি-স্বরূপকাঠির সীমান্ত আটঘর-কুড়িয়ানা এলাকা পরিণত হয়েছে যেন এক নৌ সা¤্রাজ্যে। চলছে জমজমাট নৌকার ব্যবসা। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এ ব্যবসা এলাকার মানুষের কাছে একটি অন্যতম ঐতিহ্য। চোখে নাদেখলে মনেই হবে না জলে-ডাঙায় এক সঙ্গে এত নৌকার সমারোহ ঘটতে পারে। তবে কমবেশি ভ্রমন পিপাশুদের নজর করে এই নয়নাভিরাম নৌকার ভাসমান হাট। প্রতিনিয়ত এখানে আসছে তারা নৌহাট উপভোগ করতে। পিরোজপুরের সুন্দরী কাঠ সমৃদ্ধ এলাকা স্বরূপকাঠি উপজেলা এবং ঝালকাঠি সদর উপজেলার ২০ গ্রামের দেড় হাজারের বেশি পরিবার কয়েক যুগ ধরে নৌকা-বৈঠা তৈরি ও বিক্রি করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করছেন।
জানা যায়, এ অঞ্চলের কৃষিজীবী মানুষের জীবন-জীবিকার প্রধান বাহনই হচ্ছে নৌকা। আর তাই নৌকা বেচা-কেনাকে কেন্দ্র করে সন্ধ্যা নদীর শাখা খালে যুগের পর যুগ বসছে নৌকার হাট। প্রতি শুক্র এবং রোববার বসে এ হাট।
স্বরূপকাঠির আটঘর, আদমকাঠি, জিন্দাকাঠি, বাস্তকাঠি, বেংগুলী, দলহার, আতাপাড়া, ইন্দুরকানী, কুড়িয়ানা, ঝালকাঠির ভিমরুলী, শেখেরহাট, শতদশকাঠি, কাপুড়কাঠি, কৃর্ত্তিপাশা, জগদিশপুর, পোষন্ডা, শাখাকাচি, কাচাবালিয়া ও গাগর এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে এ নৌ সা¤্রাজ্য।
কুড়িয়ানা হাটের ইজারাদার মোস্তফা কামাল জানান, ২ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত নৌকা বিক্রি হয় এ হাটে। জেলার বাইরে থেকে বড় বড় ট্রলার এসে পাইকাররা একসঙ্গে ১৮ থেকে ২০টি নৌকা কিনে তারা অন্য জেলায় নিয়ে বিক্রি করেন।
এ অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা যেহেতু নৌকায় করে খালের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য করেন, সে কারণেই ডিঙি নৌকার চাহিদা বেশি। জ্যৈষ্ঠ থেকে কার্তিক এ ছয় মাস আটঘর খালে প্রতি শুক্র এবং রোববার ক্রেতা-বিক্রেতার নৌকা ও বৈঠা বেচা-কেনা চলে। প্রতি হাটে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার নৌকা বিক্রি হয়। আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে ৩ থেকে সাড়ে তিন কোটি টাকারও বেশি নৌকা বিক্রি হয় এই হাটে।
নৌকা বিক্রেতা নাদিম মিস্ত্রি জানান, প্রতিবছর জ্যৈষ্ঠ মাস থেকে নৌকা তৈরির কাজ শুরু করেন যা চলে আশ্বিন মাসের শেষ পর্যন্ত। কিন্তু কাঠ সংকট, কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি ও গ্রামাঞ্চলে নৌকা ব্যবহার কমে যাওয়ার কারণে নৌকা কারিগররা আগের মতো নৌকা তৈরিতে ক্রমশ আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
কুড়িয়ানা বাজারে ঘরের সামনে বসেই নৌকা তৈরি করছেন ষাটোর্ধ্ব মো. আজিজুল হক। তাকে সাহায্য করছেন তারই পুত্র মো. মাহবুব হক মৃধা (৩০)। তারা জানান, নৌকা তৈরির জন্য কাঠ সংকট। স্বমিলে গাছ কাটাতে গেলে সবসময় বিদ্যুৎ না পাওয়ায় অনেক সময় ধরে অলসভাবে বসে থাকতে হয়। গাছের সিএফটি প্রতি ১০/১২ টাকা বেড়েছে। কেবি প্রতি গাছে গত বছরের চেয়ে ৫ থেকে ৭ টাকা করে বেশি দিতে হচ্ছে। এসব কারণে নৌকা তৈরি করে বিক্রি করতে গেলে চাহিদা অনুযায়ী দাম পাওয়া যাচ্ছে না।
আরেক নৌকা ব্যবসায়ী মো. মনিরুল ইসলাম জানান, বৈশাখ মাসের দিকে নৌকা তৈরির মিস্ত্রিদের ঋণ হিসেবে টাকা (দাদন) দেয়া হয়। মিস্ত্রিদের কাছ থেকে নৌকা নেয়ার সময় বাজার মূল্য থেকে ৪ থেকে ৬০০ টাকা কম দেয়া হয়।
বিনয়কাঠি থেকে নৌকা কিনতে আসা মো. আইউব আলী তালুকদার জানান, ২ হাজার ৮০০ টাকা দিয়ে একটি ডিঙি নৌকা কিনেছি। তিনি জানায় তার গরুকে ঘাস খাওয়ানোর জন্য ঘাস সংগ্রহ করতে গেলে পানির জন্য সমস্যা পরেন। তাই নৌকায় করে ঘাস কেটতে সুবিদা হবে, এতে করে আমার গরুকে তাজা ঘাস এনে খাওয়ানো যাবে।
অন্যদিকে ইজারাদারদের অত্যাচারের মাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসার সম্পূর্ণ মুনাফা ভোগ করতে পারছেন না ছোট বড় কারিগর ও বিক্রেতারা।
এদিকে তাদের যুগ যুগ ধরে চলে আসা ঐতিহ্যবাহী নৌহাট সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে নেয়া হোক সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানান এ অঞ্চলের নৌকা ব্যবসায়ীরা।
এব্যাপারে ঝালকাঠি বিসিকের উপব্যবস্থাপক জালিছ মাহমুদ বলেন, ঝালকাঠি জেলার আওতায় নৌকা তৈরীর কাজে সংশ্লিষ্ঠ মিস্ত্রীরা ঋণ সহায়তা নিতে এলে নিয়মানুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।