বাগেরহাটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে উল্লেখযোগ্য সাফল্য নেই। গত আট দিন ধরে চলা এই অভিযানে জেলার নয়টি উপজেলায় অর্ধশতাধিক মাদকসেবী আটক হয়েছে। তবে ধরা পড়েনি বড় কোনো বিক্রেতা বা ডিলার। উদ্ধার হয়নি বড় কোনো মাদকের চালান। এই অবস্থায় উদ্বেগ বেড়েছে সচেতন অবিভাবক ও নাগরিক সমাজের মধ্যে।
তবে পুলিশ বলছে, মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হওয়ার খবরে তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ীরা আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় তাদের ধরা সম্ভব হচ্ছে না। তাদের ধরতে পুলিশ তৎপর রয়েছে।
জেলা পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা দুই শতাধিক। আর এদের নিয়ন্ত্রণ করেন দশজন প্রভাবশালী গডফাদার। তবে পুলিশ তাদের নাম-পরিচয় জানাতে রাজি হয়নি।
পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বাগেরহাট শহরের পুরাতন বাজারের মীরেবাড়ির মমতাজ বেগম, রুলি বেগম, মুক্ত মীর, নাগেরবাজারের শাহানা ও সালমান, সদর উপজেলার বারাকপুর এলাকার রাজু ও শহীদুল, কচুয়া উপজেলার গোয়ালমাঠ এলাকার মাহবুব খান, রিপন, সালাম, শওকত, মোরেলগঞ্জ উপজেলার শহীদ, মহসিন, ফকির শহীদুল ইসলাম, দেলোয়ার ওরফে দেলো, জামাল, পূর্ণিমা, রফিক, এমদাদ, সুজন, নাসির এবং ফকিরহাট উপজেলার ভাইরাস কামাল ও ইকবাল দীর্ঘদিন ধরে মাদক ব্যবসা করে আসছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাদকের সহজলভ্যতার কারণে বাগেরহাটের বিভিন্ন স্কুল কলেজে পড়া কিশোর ও তরুণরা ধীরে ধীরে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। যার মাশুল দিতে হচ্ছে পরিবারকে। গত দশ বছরে বাগেরহাট শহরের অসংখ্য কিশোর তরুণ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। মাদকাসক্ত হয়ে পড়া ওই তরুণদের মাদক থেকে ফিরিয়ে আনতে না পেরে অনেক পরিবারই তাদের সন্তানদের মাদক নিরাময় কেন্দ্রে পাঠিয়ে সংশোধন করার চেষ্টা করেছেন। কেউ কেউ ভয়াল ওই মাদকের থাবা থেকে ফিরতে পেরেছে, আবার অনেকে এখনো মাদক সেবন করে যাচ্ছেন। বাগেরহাটের মাদকসেবীরা ফেনসিডিল, গাঁজা, ইয়াবা ও কাঁশির সিরাপে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে সেবন করে থাকে। তবে এদের বেশির ভাগই ইয়াবায় আসক্ত।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাগেরহাট শহরের পুরাতন বাজারের মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি ঢাকাটাইমসকে বলেন, আমি ৯০ এর দশকে কোরিয়াতে যাই। সেখান থেকে দেশে ফিরে ফেনসিডিলে আসক্ত হয়ে পড়ি। আমার এলাকায় বেশ কয়েকজন মাদক বিক্রেতা রয়েছেন। কিছু পুলিশ সদস্যের সঙ্গে তাদের দারুণ সখ্যও আছে। টাকা দিলে সহজেই আমি তাদের কাছ থেকে মাদক পেয়ে যেতাম। আমার এই নেশার কথা পরিবার জেনে যায়। যার কারণে আমার পরিবারের সাথে প্রায়ই এই নিয়ে ঝগড়া বিবাদ লেগে থাকত। আমি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছি বুঝতে পেরে মাদক থেকে ফেরার উদ্যোগ নিই। আমি মাদক ছেড়ে বর্তমানে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করছি। পুলিশ চাইলে এই মাদক ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বাগেরহাট শিল্প ও বণিক সমিতির সাবেক এক শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতা ঢাকাটাইমসকে বলেন, আমার একমাত্র ছেলে ইয়াবা নামক মাদকে আসক্ত। আমি বেশ কয়েকবার ছেলেকে মাদক থেকে ফেরাতে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে পাঠাই। কিছুদিন ভালো থাকে তারপর আবার শুরু করে। এই ছেলেকে নিয়ে আমি দুশ্চিতায় রয়েছি।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, মাদকের সহজলভ্যতার কারণে আমার ছেলে আজ মাদকাসক্ত। শহরে হাত বাড়ালেই মাদক পাওয়া যায়। অনেক চেষ্টা করেও তাকে ভালো পথে ফেরাতে পারছি না। যারা মাদকের ব্যবসা করেন পুলিশ তাদের চেনেন। তাদের ধরতে পারলে এটা বন্ধ করা সম্ভব বলে মনে করেন ওই ব্যবসায়ী নেতা।
বাগেরহাটের সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি অধ্যাপক চৌধুরী আব্দুর রব ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বাগেরহাট শহরসহ জেলার শিশু-কিশোর ও তরুণ সমাজের একটা অংশ মাদকের ভয়াল থাবায় পড়েছে। যা উদ্বেগজনক। এজন্য বাবা মায়ের অসচেতনতাই বেশি দায়ী। তাদের সন্তাননা বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথায় যাচ্ছে, কোন বন্ধুদের সাথে মেলামেশা করছে এগুলো দেখার দায়িত্ব অবিভাবকদের। অবিভাবকদের উচিত তাদের সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুর হাত বাড়ানো। তাহলেই মাদক থেকে এই প্রজন্মকে দূরে রাখা যাবে।’
‘অভিভাবকদের সচেতনতার পাশাপাশি যারা আইনশৃঙ্খলার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন তাদের মাদক বিক্রেতাদের ধরে আইনের আওতায় আনতে হবে। তা নাহলে মাদক সামনে আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।’
বাগেরহাটের পুলিশ সুপার পংকজ চন্দ্র রায় ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বাগেরহাট জেলায় তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা দুই শতাধিক। মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশ জিরো ট্রলারেন্সে রয়েছে। জেলার নয়টি থানায় গোয়েন্দা পুলিশসহ একাধিক পুলিশের দল নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। ওই দলগুলো বিভিন্ন এলাকায় তল্লাশি চেকপোস্ট বসিয়ে অভিযান চলাচ্ছে। গত আট দিনে আমরা অর্ধশতাধিক মাদকসেবীকে বিভিন্ন ধরনের মাদকসহ আটক করেছি।’
এসপি জানান, এসময় তাদের কাছ থেকে ১৬৯ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, পৌনে দুই কেজি গাঁজা, চার লিটার মদ এবং ২৩ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের অভিযানের খবর পেয়ে জেলার তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ীরা আত্মগোপনে গেছে আবার অনেকে জামিনে মুক্ত আছেন। তাদের ধরতে পুলিশ বাহিনী তৎপর রয়েছে।’
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বাগেরহাট কার্যালয়ের পরিদর্শক নিরঞ্জন কুমার সিকদার ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকা অনুযায়ী বাগেরহাট জেলায় ১৫৩ জন মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে। এদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন জেলার দশজন প্রভাবশালী (গডফাদার) ব্যক্তি। এরমধ্যে তিনজন বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন এবং দু’জন বিদেশে পালিয়ে গেছেন। বাকিরা এখন এলাকা ছাড়া। তবে এদের নাম বলা যাবে না। জেলার মাদক ব্যবসায়ীদের ধরতে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
এই কর্মকর্তা বলেন, ‘গত আট দিনে আমরা চারজনকে ধরেছি এবং নয়টি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করেছি। আমাদের পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় অভিযানে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটছে।’