ধর্ম ডেস্ক: মানবসভ্যতার ইতিহাসে কিছু অধ্যায় আছে, যেগুলো কেবল অতীতের স্মৃতি নয়, বরং যুগযুগান্তরের জন্য আয়না। আন্দালুস, যে ভূমি একসময় মুসলিম সভ্যতার আলোয় দীপ্ত ছিল,আজ নিছক পর্যটনকেন্দ্র, নিঃশব্দ ধ্বংসস্তূপ, নিভে যাওয়া প্রদীপের ভস্ম।
আন্দালুস হারানো মানে শুধু একটি ভৌগোলিক অধ্যায় হারানো নয়, এটি ছিল মুসলিম উম্মাহর সেই হৃদয়ভঙ্গ, যার প্রতিধ্বনি আজও আমাদের ইতিহাসে শোনা যায়।
৭১১ খ্রিস্টাব্দে যখন তারিক ইবনে জিয়াদের বাহিনী জাবাল তারিক (জিব্রাল্টার) প্রণালী অতিক্রম করে আইবেরীয় উপদ্বীপে প্রবেশ করে, তখন ইউরোপ নিমজ্জিত ছিল অন্ধকারে। অজ্ঞতা, নিরক্ষরতা, দমন আর ধর্মীয় গোঁড়ামি ইউরোপকে শৃঙ্খলিত করেছিল। অথচ সেই মুহূর্তে মুসলিমরা কেবল তলোয়ার নিয়ে প্রবেশ করেনি, বরং সঙ্গে এনেছিল নতুন এক সভ্যতার দ্যুতি, ন্যায়বোধ, বিজ্ঞান, শিল্প ও মানবিকতার আলো।
আন্দালুস দ্রুত হয়ে ওঠে বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ এক নগরসভ্যতা। কর্ডোবা শহরে তখন জ্বলছিল তিন লাখ প্রদীপ, যখন লন্ডনের পথে মশালের আলো ছিল বিরল। কর্ডোবার গ্রন্থাগারে ছিল অর্ধ মিলিয়নের বেশি বই, অথচ ইউরোপের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় তখনও জন্ম নেয়নি।
এই ভূমি হয়ে উঠেছিল জ্ঞানের মিলনস্থল মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদি একসঙ্গে বসে দর্শন, চিকিৎসা, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, সাহিত্যের চর্চা করত। ইবনে রুশদ, ইবনে হাযম, আল-জাহরাওয়ি কিংবা মূসা ইবনে মাইমুনের মতো মনীষীরা মানবসভ্যতার উত্তরাধিকার সমৃদ্ধ করে গেছেন।
কর্ডোবার জ্যোতির্বিদরা তারার মানচিত্র এঁকেছিলেন, যা পরবর্তীতে ইউরোপীয় নাবিকদের সমুদ্রযাত্রায় দিকনির্দেশ দিয়েছিল। চিকিৎসাবিদ আল-জাহরাওয়ির লেখা শল্যবিদ্যার গ্রন্থ শতাব্দীর পর শতাব্দী ইউরোপের মেডিকেল স্কুলে পাঠ্যপুস্তক ছিল। আন্দালুস ছিল মানবতার সেই বাগান, যেখানে ধর্ম ও সংস্কৃতির বিভাজন মুছে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল এক নতুন সামঞ্জস্য।
কিন্তু গৌরবের মধ্যেই লুকানো ছিল পতনের বীজ। প্রথম যুগে মুসলিমরা ঐক্যবদ্ধ খলিফাতন্ত্রের অধীনে এগিয়ে চললেও পরবর্তী সময়ে ক্ষমতার লোভে বিভক্ত হয়ে পড়ে ছোট ছোট আমিরাত ও সালতানাতে। প্রত্যেকে নিজেদের স্বার্থে অপরজনকে দুর্বল করতে খ্রিস্টান রাজ্যগুলোর সাহায্য নেয়। ইতিহাসে এই বিশ্বাসঘাতকতা আন্দালুসের সর্বনাশ ডেকে আনে। যখন মুসলিমরা একে অপরের বিরুদ্ধে বিদেশিদের আহ্বান করছিল, তখন শত্রুপক্ষ শক্তি সঞ্চয় করে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিল।
আরেকটি বড় কারণ ছিল ভোগবিলাস ও আভিজাত্যের নেশা। যারা একসময় আল্লাহর পথে ত্যাগ স্বীকার করে এই সভ্যতা গড়েছিলেন, তাদের উত্তরসূরিরা ডুবে গেল বিলাসবহুল প্রাসাদ, দামী রত্ন, সুরা আর ভোজনবিলাসে।
ইবনে খালদুন যথার্থই বলেছেন “সভ্যতার পতন শুরু হয় তখনই, যখন এর অধিবাসীরা আভিজাত্যে নিমজ্জিত হয়”। জ্ঞানচর্চা আর ইবাদতের জায়গা দখল করল আত্মতুষ্টি ও গাফিলতি।
এদিকে ইউরোপ জেগে উঠছিল। মুসলিমদের তৈরি করা জ্ঞানভাণ্ডার অনুবাদ হতে লাগল লাতিন ভাষায়। আন্দালুসের আলো থেকে ইউরোপের রেনেসাঁর শিখা প্রজ্বলিত হলো, অথচ মুসলিমরা সেই আলোকপ্রদীপ রক্ষা করতে ব্যর্থ হল। তারা হারাল মুক্তচিন্তার উন্মুক্ততা, ভেঙে গেল দর্শন ও বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ। সংকীর্ণতায় আবদ্ধ হয়ে পড়ল শিক্ষাব্যবস্থা, আর রাজনৈতিকভাবে তারা দুর্বল হয়ে গেল।
অবশেষে এলো সেই কালো দিন। দীর্ঘ “রিকনকুইস্তা” অর্থাৎ খ্রিস্টান রাজ্যগুলোর পুনর্দখল অভিযানের চূড়ান্ত ফলশ্রুতিতে ১৪৯২ সালের জানুয়ারি মাসে গ্রানাডার পতন ঘটে। নাসরিদ আমির বোয়াবদিল আলহাম্ব্রার চাবি ক্যাথলিক রাজা-রানির হাতে তুলে দেন। তখন কেবল একটি নগরীর পতন হয়নি, বরং সাত শতকের সভ্যতা ইতিহাসের কবরস্থানে দাফন হলো।
গ্রানাডার পতনের পর শুরু হলো এক ভয়াল অধ্যায়। লাখ লাখ মুসলমান ও ইহুদি হয় জোরপূর্বক খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হল, নয়তো হত্যা করা হলো। গ্রন্থাগারগুলোতে আগুন দেওয়া হলো, অমূল্য পান্ডুলিপি ছাই হয়ে গেল। আন্দালুসের সোনালি অতীত রূপ নিল এক ভৌতিক শূন্যতায়। ইতিহাসবিদদের মতে, শুধু গ্রানাডায় পতনের পর কয়েক দশকে প্রায় এক মিলিয়নের বেশি মুসলমান হত্যা বা বিতাড়িত হয়েছিল। আন্দালুস, যা ছিল মানবতার সহাবস্থানের প্রতীক, তা পরিণত হলো ধর্মীয় নিপীড়নের নির্মম পরীক্ষাগারে।
তাহলে কেন হারালাম আমরা আন্দালুস? কারণ আমরা ভুলে গিয়েছিলাম আমাদের মূল পরিচয়। আমরা ঐক্য হারিয়েছি, জ্ঞানচর্চা ছেড়ে দিয়েছি, ভোগবিলাসে নিমজ্জিত হয়েছি। আমরা ভেবেছিলাম ক্ষমতা চিরস্থায়ী, অথচ ইতিহাস বারবার শিখিয়েছে ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী, কেবল আদর্শই চিরন্তন।
আজকের উম্মাহর জন্য আন্দালুস নিছক ইতিহাস নয়, বরং জীবন্ত শিক্ষা। ফিলিস্তিন থেকে কাশ্মীর, সিরিয়া থেকে ইয়েমেন সবখানেই আজ আমরা বিভক্ত, দুর্বল, বাইরের শক্তির করুণায় জর্জরিত। আমাদের মধ্যে সেই একই রোগ—অভ্যন্তরীণ কলহ, আভিজাত্যের মোহ, জ্ঞানচর্চার প্রতি অবহেলা। ফলে আমরা নতুন নতুন আন্দালুস হারাচ্ছি।
কিন্তু ইতিহাস কেবল শোকের নয়, আশা জাগানোরও। আন্দালুস আমাদের মনে করিয়ে দেয় ঐক্য, জ্ঞান ও নৈতিকতা ছাড়া সভ্যতা টিকে না। এটি আমাদের শিখিয়েছে, অন্যের জ্ঞান গ্রহণে উন্মুক্ত না হলে আমরা অগ্রসর হতে পারি না। আর এটি আমাদের সাবধান করে দিয়েছে, বিভাজন ও বিশ্বাসঘাতকতা সভ্যতার জন্য সবচেয়ে বড় বিষ।
আজ যখন আলহাম্ব্রার প্রাসাদে সূর্যাস্ত হয়, তার লাল প্রাচীরগুলো নিঃশব্দে সাক্ষী দেয় হারিয়ে যাওয়া এক মহিমার। যেন বাতাসে ভেসে আসে এক শোকগাথা, “আমাকে হারিয়েছো তোমরা নিজেদের ভেতরেই। যদি ফিরে পেতে চাও, তবে আবার জ্বালাতে হবে জ্ঞানের প্রদীপ, জাগাতে হবে ঐক্যের শক্তি, আর ফিরিয়ে আনতে হবে নৈতিকতার মূলমন্ত্র”।