পরিবহন খাতে সুশাসন ও জবাবদিহিতার অভাব সামাজিক অনাচারকে উস্কে দিচ্ছে বলে মনে করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল। বলেন, এসব কিছুর পেছনে রয়েছে নীতিহীনতা ও দুর্নীতি।
‘দেখে শুনে মনে হয় আমাদের সবার মানসিক ভারসাম্য চলে যাচ্ছে, আমাদের সংবেদনশীলতা ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা আর চলতে পারে না, চলতে দেওয়া হবে না।’
সড়ক দুর্ঘটনায় পরিবেশ আন্দোলনকর্মী উত্তম কুমার দেবনাথ নিহতের ঘটনায় শনিবার রাজধানীর শাহবাগে আয়োজিত এক প্রতিবাদ সভায় এ কথা বলেন মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক।
এ সভার আয়োজন করে ২৪টি নাগরিক সংগঠন। এ সময় তারা সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কঠোর আইনের পাশাপাশি সড়ক ব্যবস্থাপনা উন্নত করার তাগিদ দেন।
গত ২১ মে হেমায়েতপুর বাসস্ট্যান্ডে বাসের ধাক্কার পর ট্রাকচাপায় নিহত হন পরিবেশ আন্দোলনকর্মী উত্তমকুমার দেবনাথ।
সুলতানা কামালের অভিযোগ সরকার সাধারণ জনগণের বদলে বাস মালিক ও শ্রমিকদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। তারা রাস্তায় মানুষ ‘হত্যার’ পক্ষে কথা বলে।
সভায় যোগ দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদাও। তিনি বলেন, সড়কে অবৈধ গাড়ি পার্কিং এবং ফুটপাতের উপর দোকান বন্ধ করতে হবে। এজন্য সরকারসহ সবাইকে মিলেমিশে কাজ করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে।
উত্তম কুমারের কথা উল্লেখ করে সিইসি বলেন, ‘২০০২ সাল থেকে উত্তম বাপার সঙ্গে কাজ করেছেন। তার মত সৎ, যোগ্য এবং নিষ্ঠাবান পরিবেশ কর্মীকে হারিয়ে বাপা পরিবারের অংশ হিসেবে আমিও আজ শোকাহত।’
সরকারি কর্মকমিশন পিএসসির সাবেক চেয়্যারম্যান ইকরাম আহমেদ বলেন, ‘আপনজন হারানোর ব্যাথা অন্যকে বুঝান যাবে না। আমার ছোট ছেলে ২০০৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়। সুতরাং আমি বুঝি এ যন্ত্রণা।
‘সরকারকে মোটরযান আইন সংশোধন করে যুগোপযোগী আইন করতে হবে। অথচ কয়েক বছর ধরে তা মন্ত্রণালয়ে পরে আছে। এই আইন পাস না হলে সড়ক ব্যবস্থাপনার ভালো হবে না।’
সভায় জানানো হয়, উত্তমের স্ত্রী ও দুই সন্তানের সহায়তায় বাপার উদ্যোগে একটি তহবিল খোলা হয়েছে। এতে অর্থ দিতে সবার প্রতি আহ্বান জানানো হয় সমাবেশে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘সরকারকে আমাদের পকেটের টাকা দেই রাস্তায় বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পড়ে থাকার জন্য নয়।’
‘আমরা কি স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তাটুকুও পাব না? আমরা যে কথাগুলো বলছি ভাবদৃষ্টে মনে হচ্ছে কর্তৃপক্ষের কান অবধি তা পৌঁছায় না।’
বাপার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মতিন বলেন, ‘সড়ক ব্যবস্থাপনার ব্যাপক নৈরাজ্য আজ চরমে পৌঁছেছে। উত্তমের মৃত্যুর জন্য দায়ী একটি বাস ও আরেকটি ট্রাক বেপরোয়া গতি দায়ী।’
‘তারা তা করছে অল্প সময়ে অধিক ট্রিপ করে বেশি আয়ের আকাক্ষা থেকে। অতএব এই ট্রিপভিত্তিক বেতনের চাল করা পরিবহন মালিকরাও সড়কে মৃত্যুর দায় এড়াতে পারেন না।’
স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনার জন্য কোন একক বিষয় দায়ী নয়। এ সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনাকারী, বাস্তবায়নকারী, পরিবহন মালিক ও গাড়ি চালকরা যুক্ত রয়েছে। কিন্তু এদের সমন্বযকারী কর্তপক্ষ হচ্ছে সরকার।’
ডক্টরস ফর হেলথ এনভায়রনমেন্ট এর সভাপতি এম আবু সাঈদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাহবুবা নাসরিন ও শহিদুল ইসলাম, ব্র্যাক বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধ্যাপক এটিএম নুরুল আমিন ও মাহবুব হোসেন, ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের পরিচালক গাউস পিয়ারী, ব্রতীর নির্বাহী পরিচালক শারমীন মুরশিদ, উবিনীগ এর প্রধান নির্বাহী ফরিদা পারভীন, যাত্রী কল্যাণ সমিতির মোজাম্মেল হক প্রমুখ সভায় বক্তব্য রাখেন।
সমাবেশ থেকে উত্থাপিত দাবিসমূহ
উত্তমের মৃত্যুর জন্য দায়ীদের অবিলম্বে আইনের আওতায় এনে বিচার ও উত্তমের পরিবাকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বেশ কিছু সুপারিশ করেন বক্তারা।
এর মধ্যে ছিল: মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এর যুগোপযোগী সংশোধনী আনয়ন ও বাস্তবায়ন, পথচারী ও অযান্ত্রিক যানে নিরাপদে চলাচলের উপযোগী পরিবেশ তৈরি, উল্টোপথে গাড়ি চালানো বন্ধ, যথাযথভাবে বিদ্যমান সড়ক পথ পরিচালনা ও মেরামত করা।
এর বাইরে ভুয়া লাইসেন্সধারী চালকদের শাস্তি দেয়া, পরিবহন মালিকদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা এবং অপরাধের ভিত্তিতে শাস্তির বিধান চালু, ত্রুটিযুক্ত গাড়ি বাতিল, গাড়ি চালকদের ট্রিপ এর বদলে মাসিক বেতনে নিয়োগ, সচেতনতা বৃদ্ধি, যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ, বিআরটিএকে স্বচ্ছ ও কার্যকর করা, রেল ও নৌ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ ও সম্প্রসারণ ও সড়ক নির্ভরতা কমানোসহ নানা পরামর্শ দেয়া হয় সমাবেশে।