একটি বৃহৎ তৈরি পোশাক রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক বৃহৎ ক্রেতাদের চাপে সরবরাহ বহুমুখী করতে পূর্ব আফ্রিকা বা ভারতে কারখানা স্থাপন করতে চায়, একটি বৃহৎ তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে চায়, একটি সিমেন্ট কোম্পানির ৫১ শতাংশ বিক্রি হচ্ছে একটি এশীয় সিমেন্ট কোম্পানির কাছে— প্রতিটি ক্ষেত্রেই কাজগুলো পরিচালন করছেন প্রতিষ্ঠানগুলোর সিএফও বা প্রধান অর্থ কর্মকর্তা।
বেশ কয়েক বছর আগে হয়তো প্রধান কর্মকর্তা, প্রধান হিসাব কর্মকর্তা কিংবা হেড অব অ্যাকাউন্টসের কাজের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য ছিল না। মূলত তারা ব্যস্ত থাকতেন প্রতিষ্ঠানের আয়, বিশেষভাবে ব্যয় ব্যবস্থাপনার কাজে। কিছু জায়গায় হয়তো তারা সামগ্রিক অর্থব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করতেন। তার মধ্যে এক বিরাট অংশ ছিল মূলত ডাটা কিংবা সেকেন্ডারি ডাটা নিয়ে কাজ করা; যার অর্থ হচ্ছে, ব্যালান্সশিট কিংবা কোম্পানির বুকস অব অ্যাকাউন্টস ঠিক করা। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় প্রধান অর্থ কর্মকর্তা আর প্রধান হিসাব কর্মকর্তার কাজের মধ্যে বিরাট পার্থক্যের সৃষ্টি হচ্ছে। ধীরে ধীরে প্রধান অর্থ কর্মকর্তা যেন প্রধান ব্যবসায়িক কর্মকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন। তার ভূমিকাটি মূলত কোম্পানির সামগ্রিক অগ্রগতি, কোম্পানির সামগ্রিক ভবিষ্যৎ, ব্যবস্থাপনা দক্ষতা বৃদ্ধি, বিক্রয়ের প্রবৃদ্ধি, খরচের দিকটি পুনর্গঠন, রিটার্ন অন ইকুইটি, কোম্পানির রিটার্ন অন বিজনেস, কমপ্লায়েন্স, ইন্টারনাল কন্ট্রোল, এমনকি সামগ্রিকভাবে আন্তর্জাতিক বাজার বিন্যাসে কোম্পানির ভূমিকা কী হবে, বেঁচে থাকার পদ্ধতি কী হবে, কোথায় বিনিয়োগ করবে, কোথায় বিনিয়োগ করবে না, সেগুলো দেখভালের মধ্যে এসে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত যেন একটা সত্য নতুনভাবে আবির্ভূত হচ্ছে, যেসব কোম্পানির প্রধান নির্বাহী প্রধান অর্থ কর্মকর্তা কিংবা প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা থাকবে, সেই কোম্পানিগুলোর ভবিষ্যৎ যেন আরো ভালো হবে কিংবা ভালো হতে যাচ্ছে।
ইদানীংকালে আমরা দেখেছি, পেপসিকোলা কোম্পানির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা ইন্দ্রা কে. নুয়ি যখন কোম্পানিটির প্রধান নির্বাহী হিসেবে আবির্ভূত কিংবা নিযুুক্ত হলেন, তখন পেপসিকোলা কোম্পানিটির যেন নতুন দিগন্ত উন্মোচন হলো। পেপসিকোলা একটি দক্ষ ব্যবস্থাপনাময়, লাভজনক প্রতিষ্ঠান, নতুন নতুন অভিনব উত্পাদন পদ্ধতি ও অভিনব পণ্যের সমাহার নিয়ে যেন এগিয়ে যাচ্ছে।
এখন সঙ্গত কারণেই দেখা যাচ্ছে, অনেক প্রতিষ্ঠানে হিসাববিদরা প্রধান নির্বাহী হচ্ছেন কিংবা প্রধান অর্থ কর্মকর্তা প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যতের কাণ্ডারি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন। এই যে প্রধান অর্থ কর্মকর্তার কর্মকাণ্ড একটি মহীরুহ ব্যাপ্তি লাভ করছে, তার এক বড় কারণ হচ্ছে প্রযুক্তিগত পরিবর্তনে, প্রযুক্তিগত সংস্কারে, এমনকি মার্জার অ্যান্ড অ্যাকুইজিশন কিংবা জয়েন্ট ভেঞ্চার এগ্রিমেন্ট কিংবা নতুন কোনো দেশে নতুন কোনো বাজারে তার প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা। কিংবা প্রতিষ্ঠানের কেনাবেচা, প্রতিষ্ঠানের অলাভজনক ব্যবসাগুলো ছেঁটে ফেলা। লাভজনক ব্যবসায় আরো বেশি পদার্পণ করা। এ কর্মকাণ্ডগুলোয় প্রধান অর্থ কর্মকর্তার ভূমিকা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে দেখা যাচ্ছে, যেখানে হিসাবপ্রধান মূলত বাইরের অডিটরদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের বুকস অব অ্যাকাউন্টস নিয়ে কাজ করছেন, সেখানে প্রধান অর্থ কর্মকর্তা মূলত বিজনেস প্ল্যানিং অ্যান্ড অ্যানালাইসিস করে কিংবা কোনো ধরনের টেকনোলজিক্যাল ট্রান্সফরমেশন ঘটিয়ে প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা-সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রতিষ্ঠানকে ভবিষ্যতে লাভজনকভাবে পরিচালনা করার জন্য বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি আবিষ্কারের ক্ষেত্রে কাজ করছেন। এক্ষেত্রে আরো দেখা যাচ্ছে, প্রধান অর্থ কর্মকর্তা অনেক সময় যেন প্রধান তথ্য কর্মকর্তা, প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা কিংবা আইটি হ্যাডের ভূমিকা পালন করছেন। তার কারণ প্রধান অর্থ কর্মকর্তাকে খুঁজে বের করতে হয়, তার প্রতিযোগীরা কী ধরনের ব্যবসা করছে, প্রতিযোগীদের ব্যবসার মডেল কী? ব্যবসা পরিচালনগত সমস্যা কী? সেখানে তাদের রিটার্ন অন ইকুইটি কী? রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট কী? প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো কোন কাজগুলো বেশি করছে, কোনগুলো কম করছে? এজন্য এখন দেখা যাচ্ছে সঙ্গত কারণেই প্রধান অর্থ কর্মকর্তাকে প্রযুুক্তিগত দিকে অনেক বেশি এগিয়ে থাকতে হচ্ছে।
আমরা দেখছি বাংলাদেশী অনেক প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার ছাড়িয়ে যাচ্ছে, তাদের অনেকেই প্রযুক্তিকে মনে করছে একটি প্রধান হাতিয়ার। সেক্ষেত্রে তারা ইআরপি করছে, বিআই করছে, ডাটা অ্যানালিটিকসের মাধ্যমে তারা কোন ব্যবসাটি বেশি করতে চায়, কোন ব্যবসাটি কম করতে চায়, কোন ব্যবসায় তাদের রিটার্ন বেশি, কোন ব্যবসায় রিটার্ন কম, কোন ব্যবসার মডেলে রিটার্ন পার এমপ্লয়ি বেশি, কোন এমপ্লয়িদের তাদের প্রয়োজনই নেই, কোন কোন বিভাগকে হয়তো চালনারই প্রয়োজন নেই— এসব বিষয়ে ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের চেষ্টা করছে। এ ধরনের বিষয়গুলোকে খুঁজে বের করে প্রতিষ্ঠান যেমন লাভ বাড়াতে চাইছে, তেমনটি অপ্রয়োজনীয় খরচও কমাতে চাইছে। এ কারণে যেটি আগেই বলেছি, প্রধান অর্থ কর্মকর্তা যেমনটি প্রধান বিজনেস অ্যানালাইসিস অ্যান্ড প্ল্যানিং কর্মকর্তার ভূমিকায় আবির্ভূত হচ্ছেন, তেমনটি তারা অনেক ক্ষেত্রে সব ধরনের পরিবর্তনের কাণ্ডারি হয়ে যাচ্ছেন। এ কারণেই দেখা যাচ্ছে, আমরা ইন্দ্রা কে. নুয়ির ক্ষেত্রে যেমন বলেছি, যেসব প্রতিষ্ঠানে প্রধান অর্থ কর্মকর্তা প্রধান নির্বাহী হচ্ছেন, সেই ধরনের প্রতিষ্ঠানের সাফল্য আরো বেশি অগ্রগামী হচ্ছে, আরো বেশি ভবিষ্যত্মুখী হচ্ছে এবং আরো বেশি পরিপক্ব হচ্ছে।
লেখক: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক