অনলাইন ডেস্ক: ইসলামী শরিয়তের আমলসমূহ প্রধানত দুই ধরনের। একটি হলো আল্লাহর হক, অন্যটি বান্দা বা মানুষের হক। এই দুই ধরনের আমলের মধ্যে আল্লাহ এবং তার রাসুল (সা.) কতৃক যেগুলো আবশ্যক করা হয়েছে সেগুলো ফরজ, এবং যে কাজগুলো নিষেধ করা হয়েছে বা যেগুলো করলে পরকালে শাস্তির কথা ঘোষণা করা হয়েছে সেগুলো হারাম।
ইসলামের ফরজ বিষয় এবং হারাম বিষয়সমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অল্পকিছু আমল শুধুমাত্র আল্লাহর হক। আর বাকি অধিকাংশ বিষয়গুলো মানুষের হক বা মানুষের সাথে জড়িত। নিম্নে বিশ্লেষণ করা হলো:
ইসলামের ভিত্তিসমূহ
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোন ইলাহ নেই, আর মুহাম্মাদ (সা.) তার বান্দা ও রাসুল- এ কথার সাক্ষ্য প্রদান করা, সালাত কায়েম করা, জাকাত দেয়া, বায়তুল্লাহর হজ্জ করা ও রমজানের সিয়াম পালন করা। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২১)
এখানে ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যকার কাজগুলো বিশেষত আল্লাহর হক সম্পর্কিত। কিন্তু জাকাত আদায় করাটা বান্দার সাথেও সরাসরি সম্পর্কিত। এগুলো ব্যতীত অন্য সকল শ্রেষ্ঠ বা নিকৃষ্ট আমলের সাথে মানুষের হক বা মানুষের সাথে সদাচরণ ও অসদাচরণের সম্পৃক্ততা রয়েছে।
সর্বোত্তম মানুষ যারা
ইসলাম সর্বোচ্চ মানুষের অধিকার রক্ষার তাগিদ নির্দেশ দেয়। রাসুল (সা.) বিভিন্ন হাদিসে সর্বোত্তম মানুষ বা সর্বোত্তম মুসলিমের পরিচয় তুলে ধরেছেন। আর এগুলোর অধিকাংশই মানবাধিকার বা মানবকল্যাণ সংশ্লিষ্ট।
ক. উত্তম চরিত্র
আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে যার স্বভাব-চরিত্র উত্তম, সেই তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬০৩৫)
খ. অপর মুসলিমের নিরাপত্তা
রাসুল (সা.) বলেন, যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমগণ নিরাপদ থাকে সে ব্যক্তিই প্রকৃত মুসলিম। আর যাকে মানুষ তাদের জান ও মালের জন্য নিরাপদ মনে করে সে-ই প্রকৃত মু’মিন। (তিরমিজি, হাদিস : ২৬২৭)
গ. ক্ষুধার্তকে খাওয়ানো এবং সালামের প্রসার
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করল, ইসলামে সর্বোত্তম কাজ কী? তিনি বললেন, (ক্ষুধার্তকে) অন্নদান করবে এবং পরিচিত-অপরিচিত নির্বিশেষে সকলকে (ব্যাপকভাবে) সালাম দেবে। (রিয়াদুস সালেহিন : ৮৪৯)
অর্থাৎ, মানুষের সাথে সদাচার সর্বোত্তম মুসলিম হওয়ার উপায়।
ধ্বংসকারী সাত গুনাহ
রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি হাদিসে ধ্বংসকারী সাতটি হারাম কাজ থেকে বেঁচে থাকতে বলেছেন। যার মধ্যে অধিকাংশই মানুষের হক জড়িত।
আবূ হুরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ধ্বংসকারী সাতটি কাজ থেকে তোমরা বেঁচে থেকো। প্রশ্ন করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল সেগুলো কী?
তিনি বললেন আল্লাহর সাথে শারীক করা, জাদু করা, আল্লাহ যার হত্যা নিষেধ করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করা, এতিমের মাল অন্যায়ভাবে আত্নসাৎ করা, সুদ খাওয়া, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করা এবং সাধ্বী, সরলমনা ও ইমানদার নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করা। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৬৩)
আত্মীয় ও প্রতিবেশীর হক
ইসলাম রক্তের সম্পর্ক রক্ষার প্রতি সর্বোচ্চ নির্দেশনা দিয়েছে। পাশাপাশি এতিম, মিসকিন, প্রতিবেশী, পথচারী, দাসদাসী সকলের সাথে ভালো ব্যবহার আবশ্যক করেছে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, রক্ত সম্পর্কে মূল হল রাহমান। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, যে তোমার সাথে সুসম্পর্ক রাখবে, আমি তার সাথে সুসম্পর্ক রাখব। আর যে তোমা হতে সম্পর্ক ছিন্ন করবে, আমিও সেই লোক হতে সম্পর্ক ছিন্ন করব। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৯৮৮)
আল্লাহ তায়ালা ইবাদাত ও শিরকের ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়ার পরই বলেন, পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার কর। আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গে বসা (বা দাঁড়ানো) ব্যক্তি, পথচারী এবং নিজের দাস-দাসীর প্রতিও (সদ্ব্যবহার কর)। (সূরা নিসা : ৩৬)
এতিম, বিধবা ও মিসকিনদের প্রতি সদয়
জান্নাতে রাসুলুল্লাহ (সা.)- এর সবচেয়ে কাছাকাছি থাকার উপায় হলো, এতিমের দেখাশোনা করা। সাহল ইবনু সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, আমি ও এতিমের দেখাশুনাকারী জান্নাতে এভাবে (একত্রে) থাকব। এ কথা বলার সময় তিনি তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুলদ্বয় মিলিয়ে ইঙ্গিত করে দেখালেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০০৫)
এছাড়াও আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সা.) বলেছেন, বিধবা ও মিসকীনদের অভাব দূর করার জন্য সচেষ্ট ব্যক্তি আল্লাহ্র পথে জিহাদকারীর ন্যায়। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬০০৭)
মানুষের প্রতি জুলুম করার পরিণতি
কোনো মানুষের প্রতি জুলুম করাকে ইসলাম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। যেমন, কারো অল্প পরিমাণ জমি জুলুম করে কেউ আত্মসাৎ করলে তাঁর পরিণতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, যে লোক এক বিঘত জমি অন্যায়ভাবে নিয়ে নেয়, (কিয়ামতের দিন) এর সাত তবক জমি তার গলায় লটকিয়ে দেয়া হবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২৪৫৩)
মিথ্যা বলা, চুরি করা, গীবত করা, অপবাদ দেয়া, ঘুস খাওয়া, যিনা করা, হিংসা করা ইত্যাদি সবই মানুষের হক সংশ্লিষ্ট কবিরা গুনাহ। তাই প্রকৃত মুসলিম হওয়ার জন্য আল্লাহর হক আদায়ের পাশাপাশি মানুষের সকল প্রকার হক রক্ষায়ও সচেষ্ট থাকতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, আল-হাদিস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।