
অনলাইন ডেস্ক: কোচিং নির্ভর হয়ে পড়েছে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। অলিখিতভাবে নিয়মে পরিণত হয়েছে প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত একাডেমিক কোচিং। কোচিং বাণিজ্য প্রসারে একশ্রেণির শিক্ষক ক্লাসে কোনো বিষয়বস্তুর অর্ধেক শেখান। ফলে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই কিছু বোঝে না। তাছাড়া অভিযোগ রয়েছে কোচিং না করলে নম্বর কম দেয়া এবং ফেল করিয়ে দেয়ারও। এমনকি কোচিং না করায় কোনো কোনো স্কুলে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করার ঘটনাও ঘটছে। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়ে অভিভাবকরা সন্তানদের কোচিংয়ে দিচ্ছে। বর্তমানে দেশে কোচিং-বাণিজ্যে বছরে প্রায় ৩০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। শিক্ষার জন্য অভিভাবকদের ওই অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং শিক্ষাখাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, শিক্ষার্থীদের কোচিংনির্ভর হওয়ার অন্যতম কারণ অতিমাত্রায় পরীক্ষা। বর্তমানে কোচিংনির্ভর হয়ে পড়েছে ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। আরপাঁচ বছরে কোচিং ফি ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়েছে। আর কোচিং সেন্টার চালাচ্ছে নামিদামি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা। শুধু একাডেমিক নয়, শিক্ষার্থীরা সব পরীক্ষাতেই কোচিং করছে। বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিক্যাল-ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি কোচিংয়ে বছরে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিক্যাল ভর্তি-সহায়ক বইয়ের প্রায় ৪০০ কোটি টাকা বাজার রয়েছে। আর তার অর্ধেক বই বিভিন্ন কোচিং সেন্টার বিক্রি করে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে ৬ হাজার ৫৮৭টি নিবন্ধিত কোচিং সেন্টার রয়েছে। আর নিবন্ধনহীন কোচিং সেন্টার রয়েছে ২ লক্ষাধিক। রাজধানীসহ দেশেল প্রতিটি জেলা ও উপজেলা শহরে স্কুল-কলেজের আশপাশে কোচিং সেন্টারের দেখা মিলছে। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট হলেও সিটি করপোরেশ, পৌরসভা কিংবা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ওসব কোচিং সেন্টার নিবন্ধন বা অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। তাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কোনো তদারকি নেই। যদিও বিগত ২০১২ সালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং-বাণিজ্য বন্ধে নীতিমালা প্রণয়ন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর হাইকোর্টের আদেশে ২০১৯ সালে তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। ওই নীতিমালা অনুযায়ী কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারবে না। তবে প্রতিষ্ঠানপ্রধানের অনুমতি নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের সর্বাধিক ১০ শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন। তবে ওই শিক্ষার্থীদের নাম, রোল ও শ্রেণি সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানপ্রধানকে জানাতে হবে। কিন্তু ওই নীতিমালা মানা হচ্ছে না ঢাকাসহ দেশের কোথাও। তাছাড়া নীতিমালায় কোচিং-বাণিজ্য বন্ধে তদারকি করতে মেট্রোপলিটন ও বিভাগীয় এলাকার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারকে সভাপতি করে ৯ সদস্যের কমিটি, জেলার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এবং উপজেলার ক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সভাপতি করে আট সদস্যের কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ওসব কমিটির কার্যকারিতা নেই।
সূত্র আরো জানায়, কোচিং সেন্টারগুলো শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতেও কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। বহু ক্ষেত্রেই মানহীন শিক্ষকরা সেখানে পাঠদান করছে। তাছাড়া রাজধানীকেন্দ্রিক গড়ে ওঠা বড় কোচিং সেন্টারগুলো একের পর এক শাখা খুলছে ঢাকার বাইরে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরই শুরু হয়ে যায় শিক্ষার্থীদের দৌড়াদৌড়ি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পর্যন্ত সাত-আট মাস তারা কোচিং সেন্টারের পেছনে ব্যয় করে। অনেকে তিন-চারটি কোচিং সেন্টারেও পড়ে থাকে। কারণ কোচিংয়ে ভর্তি না হয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা মেডিক্যালে সুযোগ পাওয়ার নজির খুব কম।
এদিকে শিক্ষাবিদদের মতে, শিক্ষায় দরকার বড় সংস্কার। শিক্ষাকে ক্লাসমুখী করতে হবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষকদের ক্লাসরুমে ভালোভাবে পড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও সামাজিক সম্মান বাড়াতে হবে, যাতে মেধাবী তরুণরা শিক্ষকতা পেশায় উৎসাহিত হয়। বর্তমানে দেশে কোচিং সেন্টারগুলো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মতো পরিচালিত হচ্ছে।
অন্যদিকে কোচিং সেন্টার মালিকদের মতে, কোচিং করাটা কারো জন্য বাধ্যতামূলক নয়। শিক্ষকরা ক্লাসে পড়ান না বলেই ছাত্রছাত্রীরা কোচিং সেন্টারে আসে। নীতিমালা হলে ব্যাঙের ছাতার মতো যত্রতত্র কোচিং সেন্টার গড়ে উঠবে না। নীতিমালার ভালোমন্দ দুটি দিকই আছে। কিছু কিছু কোচিং সেন্টার শিক্ষার্থীদের প্রতারণা করছে। নীতিমালা থাকলে সেটা বন্ধ হবে।