খুলনা প্রতিনিধি: ২০০৯ সালের ২৫ মে আঘাত হানা প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’ খুলনার উপকূলবাসীর জীবনে নামিয়ে আনে ভয়াবহ বিপর্যয়। সেই দুর্যোগের ১৬ বছর পরেও অনেক পরিবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। এমনই একজন মো. মোবারক হোসেন, যিনি একদিনে হারিয়েছেন সব—ভিটেমাটি, সম্পদ, আত্মীয়ের কবরস্থান, এমনকি জীবনের স্বাভাবিক গতি।
খুলনার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের পাতা জোড়সিং গ্রামের বাসিন্দা মোবারক হোসেন একসময় ছিলেন এলাকায় পরিচিত বিত্তশালী ব্যক্তি। ২২ বিঘা জমির ওপর চিংড়ি ঘের, বড় মুদি দোকান, সুন্দরবনের মাছ-মধু ব্যবসা, দশটি পাকা ঘরসহ ছিল এক সুখী যৌথ পরিবার। আইলার এক ধাক্কায় সব কিছু বিলীন হয়ে যায়।
ভিটেমাটি হারিয়ে পরদিনই ট্রলারে করে পরিবার নিয়ে খুলনায় আশ্রয় নেন মোবারক। সেখানে তাকে বারবার হতে হয় হয়রানি ও প্রতারণার শিকার। রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে পাননি সরকারি বা বেসরকারি কোনো সহায়তা। আজও তার পরিবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি।
বর্তমানে তিনি বসবাস করছেন খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার কুশারহুলা গ্রামে। টিনের ছাউনি ও বেড়ার একটি ছোট ঘর ঘিরে আবারও বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন তিনি। আইলার ধাক্কা ছিল শুধু বসতভিটা হারানোর নয়, সন্তানদের ভবিষ্যৎও থেমে যায় সেই দিন থেকে।
মোবারকের ছোট ছেলে মফিজুল ইসলামকে দুইবার বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা করা হলেও প্রতারণার শিকার হন। বর্তমানে তিনি ও তার স্ত্রী শ্রমিকের কাজ করছেন সাভার ইপিজেডে। তাদের ছোট ছেলেকে রেখে যেতে হয়েছে মোবারকের কাছে। দাদার ভাষায়, শিশুটি বয়সের তুলনায় মন্থর বুদ্ধির।
আলাদা এক বাস্তবতা ভোগ করছেন একই গ্রামের আরেক বাসিন্দা আনসার আলী। আইলার পরপরই মোবারক হোসেন এলাকা ছাড়লেও আনসার আলী দেড় বছর দোকানে আশ্রয় নিয়েছিলেন স্ত্রী-সন্তানসহ ১৩ জনকে নিয়ে। পরে তাকেও এলাকা ছাড়তে হয়। বর্তমানে তিনি ঢাকায় রিকশা চালান।
২০০৮ সালের গুগল আর্থের চিত্র বলছে, পাতা জোড়সিং গ্রামে একসময় ছিল ঘন বসতি। ২০১০ সালের ছবি বলছে, সে জনপদে এখন খালের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে নদীর পানি। স্থানীয়রা জানান, আইলার সময় নদীর বাঁধ ভেঙে সেই খালের সৃষ্টি হয়। এখন সে স্থান পরিচিত ‘হারেজখালী ক্লোজার’ নামে।
আইলা, আম্পান, সিত্রাং—একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ খুলনার উপকূলীয় জনপদকে পরিণত করেছে এক প্রকার জলবায়ু যুদ্ধক্ষেত্রে। বাস্তুচ্যুতি এখানকার সাধারণ ঘটনা।
কয়রার আরেক বাসিন্দা কামরুল সরদার পরিবার নিয়ে ২০২০ সালের আম্পানের পর পাড়ি জমান খুলনা শহরে। বর্তমানে ভ্যান চালিয়ে জীবিকা চালালেও সন্তানদের শিক্ষার পরিবর্তে পাঠিয়েছেন কাজ করতে। তার ৮ বছর বয়সী ছেলে হোসাইন এখন চানাচুর বিক্রি করে। মা লতিফা পারভিন বলেন, “ওর ব্রেন ভালো, কিন্তু খরচ চালাতে না পেরে ওকে কাজে নামাইছি।”
নরওয়েভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের (IDMC) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে জলবায়ু দুর্যোগের কারণে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৪ লাখে। আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ১৮ লাখ। বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে পঞ্চম স্থানে।
বিশ্বব্যাংকের ‘গ্রাউন্ডসওয়েল’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে ১ কোটির বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে খুলনার উপকূলীয় এলাকা।
যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি এবং নাসার গবেষণায়ও উঠে এসেছে একই সতর্কতা। গবেষকরা বলছেন, অতীতে যেসব বড় ঘূর্ণিঝড় ১০০ বছরে একবার ঘটত, এখন তা ১০ বছরেই ঘটছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দুর্যোগের ঘনত্ব ও তীব্রতা বাড়ছে।
ঘূর্ণিঝড় আইলার ১৬ বছর পার হলেও মোবারক হোসেন ও তার মতো আরও অনেক বাস্তুচ্যুত মানুষ রয়ে গেছেন পুনর্বাসনের বাইরে। তাদের হারানো কিছুই ফিরে আসেনি—না ভিটেমাটি, না আত্মীয়স্বজনের কবর, না সন্তানদের স্বপ্ন। রাষ্ট্রের উচিত এসব জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য একটি স্থায়ী সমাধান ও পুনর্বাসনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।