1. rajubdnews@gmail.com : 24jibonnews : admin
শনিবার, ১৭ মে ২০২৫, ০৫:৫০ পূর্বাহ্ন
সর্বশেষ সংবাদ:
ট্রাম্পের হুমকির কাছে মাথা নত করবো না: মাসুদ পেজেশকিয়ান দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ‘শাটডাউন’ ঘোষণা সাময়িক বন্ধের পর পুনরায় অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করছে নভোএয়ার ২শ কেজি গাঁজাসহ দুই নারী আটক সাড়ে ছয় ঘণ্টা অবস্থানের পর শাহবাগ মোড় থেকে নার্সিং শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দেয়া হয়েছে নেত্রকোণায় বজ্রপাতে এক যুবকের মৃত্যু জাহাঙ্গীর কবির নানক ও তার স্ত্রী-কন্যার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যার ঘটনায় বৃহস্পতিবার অর্ধদিবস বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ পৃথিবীর ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা ছাত্র সমাজই ঠিক করবে : প্রধান উপদেষ্টা হলোখানায় প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে মেয়েকে হত্যার অভিযোগে পাষণ্ড পিতাসহ গ্রেফতার-৩

আমাদের চিরদিনের সহযাত্রী

প্রতিনিধির নাম :
  • আপডেট এর সময় : বৃহস্পতিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৭

তাঁর নাম শুনেছি। কবিতা পড়েছি।
গল্প-উপন্যাস পড়েছি। আর শুনেছি তাঁর গান। সিনেমার গান। দূর থেকে তাঁকে দেখেছি দু-একবার। কথা হয়নি। ছাত্রজীবন থেকেই বিভিন্ন কাগজে অর্থনীতি ও সমাজ বিষয়ে লিখি। তাই হয়তো নামটি তাঁর জানা ছিল। সেই ভরসায়ই ১৯৭৮ সালের শেষ দিকে উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডনে পৌঁছেই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের উদ্যোগ নিই। তিনি তখন বুস হাউসে বিবিসি বাংলা বিভাগে কাজ করছিলেন। টেলিফোন করতেই বললেন, ‘চলে এসো’। পাস দিয়েই রেখেছিলেন। তাই পৌঁছতে অসুবিধা হলো না। গিয়ে দেখলাম তিনি টাইপরাইটারে লিখছেন। বিবিসি বাংলার সংবাদ ও ‘প্রবাহ’ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে। সংক্ষেপেই পরিচয় করিয়ে দিলেন সিরাজুর রহমান, শ্যামল লোধ ও দীপঙ্কর ঘোষের সঙ্গে। বসে রইলাম অনুষ্ঠান ‘অন এয়ারে’ যাওয়া পর্যন্ত। তারপর আলাপ। বললাম, কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে পড়তে গিয়েছি লন্ডনে। বাড়িভাড়া, যাতায়াত ও অন্যান্য খরচ বাদে হাতে যা থাকে, তা থেকে পেছনে ফেলে আসা ভাই-বোনদের ঢাকায় থাকা-খাওয়া ও পড়াশোনার খরচ কুলিয়ে উঠতে পারছি না। তাই বিবিসি বাংলায় পার্ট টাইম একটা কাজ পেলে খুব ভালো হতো। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তাঁর সহকর্মীদের বললেন, আমাকে ‘ওসি’ বা ‘আউটসাইড কন্ট্রিবিউটর’ হিসেবে কাজ দেওয়া যায় কি না। একই সঙ্গে একটি ইংরেজি রিপোর্টের বাংলা করতে দিলেন। তা দেখে মনে হলো খুশিই হলেন। আর সেভাবেই বিবিসি বাংলা বিভাগে আমার ‘পার্ট টাইম’ কাজের শুরু। সপ্তাহে দু-তিন দিন যেতে হতো। সপ্তাহান্তে প্রায়ই যেতাম। আমার বিশ্ববিদ্যালয় বুস হাউসের কাছেই বলে আসা-যাওয়ার পথে দুই-তিন ঘণ্টা কাজ করে যেতাম। অর্থ খুব বেশি নয়; কিন্তু বাড়তি উপার্জন বলে খানিকটা স্বস্তি পেলাম। তিনি অবশ্য অল্প কিছুদিন পরই বাংলাদেশে ফিরে এলেন। আমি রয়ে গেলাম বিবিসি বাংলা বিভাগের একজন নিয়মিত ‘বাইরের অংশগ্রহণকারী’ হিসেবে। সিরাজ ভাই, শ্যামল দা, দীপঙ্কর দা, নূরুল ইসলাম, ঝর্ণাদি, নিমাইদা, মোর্শেদা আপাসহ প্রায় সবার আনুকূল্যে এই বাড়তি উপার্জনের সুযোগটি আমার লন্ডন জীবনের পুরোটা সময় ধরেই নিশ্চিত ছিল। এই বুস হাউসেই এই কাজের সুবাদে পরিচিত হলাম আমার মতো আরো অনেক ‘ওসি’র সঙ্গে। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, নাজির আহমেদ, মানসী বড়ুয়া, চন্দন মিত্রসহ আরো অনেকের সঙ্গেই। বিবিসির নানা অনুষ্ঠানে আমি অংশগ্রহণ করেছি তাঁদের সঙ্গে। বিবিসি ক্যান্টিনে চলত আড্ডা। হক ভাই চলে এলেও তাঁর কথা ভুলিনি আমি। উচ্চশিক্ষা শেষ করে দেশে ফিরে এসে ‘ভাষা আন্দোলনের আর্থ-সামাজিক পটভূমি’ শীর্ষক গবেষণা প্রকল্প হাতে নিলাম। এই প্রকল্পটির জাতীয় গুরুত্ব বিবেচনা করেই প্রয়াত গাজিউল হক, কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হকসহ আরো অনেককেই নিয়ে আসতাম আমাদের পাওয়া তথ্যগুলো নিয়ে সেমিনারে।

আমার স্পষ্ট মনে আছে, কবি শামসুর রাহমান ও সৈয়দ শামসুল হক অনেকটা সময় দিয়েছেন আমাদের গবেষণাকে আরো শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর জন্য। বিআইডিএসে সাধারণত অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা হতো। সেখানে ইতিহাসনির্ভর একটি আর্থ-সামাজিক গবেষণা তাঁদের বেশ উত্সাহিত করেছিল। বাংলা একাডেমির তত্কালীন মহাপরিচালক মনজুরে মওলাকে আকর্ষণ করে এই গবেষণা। তাই এ গবেষণার ফলাফল নিয়ে তিনিও এক বিশেষ আলোচনার আয়োজন করেন। ভাষা আন্দোলনের সেই কাজটি ইউপিএল প্রথমে পাঁচ খণ্ডে এবং পরে এক খণ্ডে প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বাংলা জার্নাল ‘সমীক্ষা’রও বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল এই গবেষণার ফলাফল নির্ভর রচনাগুলো নিয়ে। এরপর হক ভাইয়ের সঙ্গে যেখানেই দেখা হতো লন্ডনের সেই স্নেহবত্সল দৃষ্টিতেই দেখতেন আমাকে। সঙ্গে বাড়তি পাওনা ভাবির স্নেহ। বইমেলা, সাংস্কৃতিক কোনো অনুষ্ঠান, কবিতা পরিষদের অনুষ্ঠান, স্বৈরাচারবিরোধী কোনো বৈঠক—যেখানেই দেখা হতো তাঁদের দুজনের শুভেচ্ছা ও স্নেহ থেকে আমি বঞ্চিত হইনি। এরপর ঘটনাক্রমে আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদে নিয়োগ পেলাম। প্রতিষ্ঠানটিকে মানবিক করার লক্ষ্যে নিয়মিত ১৫ আগস্ট, স্বাধীনতা দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। এরই মধ্যে এসে গেল রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী। তাই কবি-সাহিত্যিকদের সংস্পর্শে রাখার চেষ্টা করেছি বাংলাদেশ ব্যাংককে। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের স্মৃতি অম্লান রাখার জন্য স্মারক মুদ্রা ও নোট প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জাতীয় জাদুঘরের জন্যও একটি স্মারক নোট প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তা ছাড়া বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, মুস্তাফা নূর-উল ইসলাম, হায়াত্ মামুদ, সৈয়দ শামসুল হক, আনোয়ারা সৈয়দ হক, মনজুরে মওলা, সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, সেলিনা হোসেনসহ আরো অনেককে নিয়ে আমরা একত্রিত হয়েছি নৈশভোজে। উদ্দেশ্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু মুদ্রানীতি করেই যে তার হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে না—এ দেশের শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতির প্রসারেও সামাজিক দায়িত্ব পালন করে, সে কথাটি আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের পুরোধাদের সামনে আলাপচারিতায় তুলে ধরা। অধ্যাপক খান সারওয়ার মুর্শিদকে নিয়েও আমরা আরেকটি আয়োজন করেছিলাম। গভর্নর ভবনেও এক-দুইবার শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত গুণীজনদের নৈশভোজের আয়োজন করেছিলাম।

হক ভাইয়ের সঙ্গে সর্বশেষ মঞ্চে উঠেছিলাম ২৯ মে ২০১৫। সোহরাওয়ার্দী ময়দানে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন, সমুদ্রসীমা পুনর্নির্ধারণসহ রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতির নানা অঙ্গনে তাত্পর্যপূর্ণ সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যে গণসংবর্ধনা দেওয়া হয় সেই অনুষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। নাগরিক সমাজের নানা অংশের প্রতিনিধিরা সেদিন বঙ্গবন্ধুকন্যার অবদান বিষয়ে কথা বলেন। আমি বলেছিলাম আর্থিক খাতের উন্নতির নানা দিকের ওপর। হক ভাই, আমাদের সবার ভাবনাকে সমন্বিত করে এক অসাধারণ ভাষণ দিয়েছিলেন সেদিন। তখন তাঁর শরীরে মরণব্যাধি বাসা বেঁধে বসে ছিল। কিন্তু অসুস্থ শরীরেই গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরম উপেক্ষা করে তিনি নাগরিক কমিটির প্রধানের দায়িত্ব পালনে সামান্য দ্বিধা করেননি। না করারই কথা। মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু ছিল তাঁর কাছে অবিচ্ছিন্ন। তাঁর কবিতা, গান, উপন্যাস ও প্রবন্ধ—সর্বত্রই এই তিনের উপস্থিতি। সে কারণেই ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখে যখন এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন, তখন পুরো জাতি শোকে মুহ্যমান। শিল্প ও সাহিত্য অঙ্গন বাকহারা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বক্ষণ কবির চিকিত্সার খোঁজখবর নিতেন। দৌড়ে হাসপাতালে চলে যেতেন। সব্যসাচী এই লেখকের মৃত্যুর পর তিনি তাই তাঁকে ‘জাতির বিবেক’ বলে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। শুধু প্রধানমন্ত্রীই নন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রতিটি সচেতন মানুষ সৈয়দ হকের প্রয়াণে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। শহীদ মিনারে তাঁর মরদেহে সর্বস্তরের সংস্কৃতিকর্মী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঞ্চারী সংগঠনের পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।

৮১ বছরের পূর্ণ জীবন অতিবাহিত করেই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। ঠিক রবীন্দ্রনাথের মতোই। আমি তাঁর লেখার এক অন্ধ ভক্ত। কবিতা, উপন্যাস ছাড়াও তিনি যে কলাম লিখতেন দৈনিক সংবাদে, তা আমি গোগ্রাসে পড়তাম। তাঁর ‘হূত্ কলমের টানে’ পড়ে মনে হতো তিনি মুক্তবুদ্ধির প্রচারে, সুরুচির প্রসারে শক্ত হাতে কলম ধরেছেন। এমন কাব্যিক গদ্য, ভাষার ভাঙাগড়া, শব্দের সুষমা খুব কম কলামিস্টের কলম থেকেই বের হতো। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক বাঙালি এবং একই সঙ্গে আধুনিক। তিনি ব্যক্তির কথা বলতে গিয়ে আসলে সমগ্রের কথাই বলতেন। তাঁর কলামগুলো সম্পাদিত বই ‘জলেশ্বরীর দিনপত্রী’ থেকে কয়েকটি উদ্ধৃতি দিয়ে বোঝাতে চাই, তিনি একই সঙ্গে কতটা প্রগতিশীল ও ঐতিহ্যভক্ত ছিলেন। পুরো সমাজ নিয়ে তিনি ভাবতেন। সাহিত্য ক্ষেত্রে আশপাশের নোংরামি, কাদা ছোড়াছুড়ি দেখে বিরক্ত সৈয়দ হক লিখেছেন, মূল্যবোধের ভাঙনের কারণেই এমনটি ঘটছে।
…“এবং এই ভাঙ্গন শুরু হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করবার মুহূর্ত থেকে। যেমনটি আমি বরাবর বলেছি; এখন আবার বলছি—বঙ্গবন্ধুকে হত্যা কেবল একটি মানুষকে হত্যা করা ছিল না, সে ছিল বস্তুত চেতনাকে হত্যা, সুস্থতাকে হত্যা, ভারসাম্যকে হত্যা, ঐকতানকে হত্যা, মানবিক সকল মূল্যবোধকেই হত্যা সে বটে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর আমাদের সড়কে সড়কে চেতনার লাশ, মূল্যবোধের লাশ, মানবের লাশ। ” (জলেশ্বরী পত্র, শুদ্ধস্বর, ২০১১, পৃ. ২৬)

মূল্যবোধের এই ভাঙনের জন্য তিনি জিয়াউর রহমানের ‘রাজনীতিকে আমি কঠিন করে তুলব’ নীতিকেই দায়ী করেছেন। তাঁর মতে, “রাজনীতি তার হাতে কঠিন নয়, সহজ হয়ে পড়েছে, … জিয়াউর রহমানের হাতে আরো যা হয়েছে, অত্যন্ত মন্দ অর্থে রাজনীতি সর্বস্তরে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়েছে। ” (ঐ, পৃ. ২৬) মন্দ অর্থে তিনি রাজনীতির খারাপ দিক—অর্থাত্ ষড়যন্ত্র, চরিত্রহনন, অন্যায় আক্রমণ ও অসত্য কথন বুঝিয়েছেন। আর এই মন্দ রাজনীতি ছিল মানুষের বিপক্ষে। সাহিত্যে তার প্রভাব দেখে তিনি ব্যথিত হয়েছেন। এই সমাজ, এই মন্দ রাজনীতির প্রভাবে এতটাই কলুষিত হয়ে পড়েছিল যে তিনি চারদিকে শুধুই দেখেছেন ‘বিষণ্নতা’। তিনি মনে করতেন, বৃষ্টির ভেতরে গাছগুলো যেমন একা, তেমনি একা তিনি। ‘চারদিক লক লক করে বেড়ে উঠছে বিষণ্নতা। ’ সেই কারণেই তিনি বারবার ‘ছাঁচে ঢালা মানুষ’ হিসেবে বেড়ে ওঠার বিপদ সম্পর্কে লিখেছেন। তিনি তাই প্রশ্ন তুলেছেন, “অর্থাত্ আমরা কি টাইপে পরিণত হচ্ছি? ব্যক্তি আমরা আর হয়ে উঠতে পারছি না? ব্যক্তির সম্ভাবনা এতে বুঝে আসছে কেন? আমরা কি হারিয়ে ফেলেছি বা ফেলছি ব্যক্তি হয়ে ওঠার কারণ, আদর্শ, কল্পনা? এই সমাজ, এই দেশ, এই রাষ্ট্র কি আজ গণতান্ত্রিক হয়েও আসলে আজ জর্জ অরওয়েলের উপন্যাস ‘নাইনটিন এইটি ফোর’-এর মতো একটি বিশেষ অর্থে স্বৈরতান্ত্রিকই হয়ে উঠেছে বটে? —যার গতি-প্রকৃতি আমরা ধরতে পারছি না এখনো?” (ঐ, পৃ. ১২৮)

এসব প্রশ্ন করে নিজেই আবার বলছেন, “স্বস্তি পাচ্ছি না। উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না তো স্বস্তি পাব কিসে?” একজন কালজয়ী লেখকের এমনই অস্বস্তি হওয়ার কথা। রবীন্দ্রনাথের ‘আত্মশক্তি’ পর্বের লেখাগুলোতেও এমন প্রশ্ন, এমন অস্বস্তির কথা লক্ষ করি।

প্রশ্ন করেই সৈয়দ হক থেমে যাননি। তিনি এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। সে জন্যই তিনি লিখতে পেরেছেন, “জাতির মানসচিত্রে যে ধস, যে ভাঙন এসেছিল, সেটা রোধ করতে হবে, এই মানসচিত্রের পুনর্নির্মাণে আমাদের ব্রতী হতে হবে। ” (ঐ, পৃ. ১৩৪) আর এই পুনর্নির্মাণের প্রধান বাধা আমলাতান্ত্রিক জটিলতার বিষয়টি উল্লেখ করতে তিনি ভোলেননি।

একজন ঔপন্যাসিকও যে আসলে সাংবাদিক, সে কথাও তিনি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন সমাজের ভেতর থেকে মানুষের মনের কথা বের করে আনতে পারেন একজন ঔপন্যাসিক। ঠিক যেমনটি এনেছেন শরত্চন্দ্র কিংবা বঙ্কিমচন্দ্র। ঐতিহাসিক পটভূমিতেও একজন সফল ঔপন্যাসিক আসলে তাঁর সময়ের কথাই বলেন বলে তিনি মনে করতেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটের মহনায়ক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বড় ক্যানভাসে ক্লাসিকধর্মী একটি উপন্যাস লেখার পুরো সক্ষমতা আমাদের এই সময়ে একমাত্র সৈয়দ হকেরই ছিল। তাঁকে আমি একবার তাই এমন একটি কাজে হাত দিতে অনুরোধ করেছিলাম। তিনি শুধু হাসলেন। মনে হলো, চ্যালেঞ্জিং এই কাজটি হাতে নিতে পারলে ভালোই হতো। শেষ পর্যন্ত এমন কাজটি হয়তো আর করে উঠতে পারেননি। সে সময় তিনি পাননি। তার আগেই মরণব্যাধি তাঁকে কাবু করে ফেলল। বঙ্গবন্ধু বিষয়ে তিনি অনেক কথাই লিখেছেন। তবে আমাকে বিশেষভাবে স্পর্শ করেছে তাঁর লেখা ‘বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে’ কবিতাটি। এর প্রথম কয়েকটি লাইন তাই তুলে ধরছি।

“এই পৃথিবীতে আর আকাশ দেখিনি আমি এতো অবনত

ঘুমন্ত শিশুর মুখে যেন চুমো খাবে পিতা নামিয়েছে মুখ;

প্রান্তর এতোটা বড় যেন মাতৃশরীরের ঘ্রাণ লাগা শাড়ি;

আদিকবি পয়ারের মতো অন্ত্যমিল নদী এতো শান্ত স্বর;

এতোটা সজল মাটি কৃষকের পিঠ যেন ঘামে ভিজে আছে; …

… আমাদের প্রধান কবিকে যারা

একদিন হত্যা করে তাঁর জন্মপল্লিটিতে মাটিচাপা দেয়

কতটুকু জানে তারা, কত ব্যর্থ? জেগে ছিল দুটি হাত,

মাটি গভীর থেকে আজো সেই হাত পুরনো কথার মতো

স্মৃতির ভেতর থেকে উচ্চারণমালা, নদীর গভীর থেকে

নৌকোর গলুই, পথিকের পদতল কাঁটায় রক্তাক্ত যদি,

সেই রক্ত শোধ হোক তাঁর কাছে ঋণ;”

এ কয়টি লাইন থেকেই আমরা অনুভব করতে পারি কী গভীর ছিল তাঁর ভালোবাসা আমাদের জাতির পিতার প্রতি। সে কারণেই আমি প্রত্যাশা করেছিলাম ‘নূরলদিনের সারা জীবনের’ চেয়েও আরো বিরাট এক ‘এপিক’ তিনি দিয়ে যাবেন আমাদের জন্য। তা সত্ত্বেও যতটুকু তিনি দিয়ে গেছেন আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে, তা-ই বা কম কী? তাঁর কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ—সব কিছুতেই যেন কাব্যিক ভাষায় সমকাল ও ভাবীকালের প্রেক্ষাপটে মানুষের জয়গান গেয়ে গেছেন। একই সঙ্গে প্রেম ও মর্যাদা, দুঃখ ও গর্ব, সহমর্মিতা ও আত্মত্যাগ, যুদ্ধ ও শান্তির এমন বড় ক্যানভাসের লেখা একমাত্র তিনিই যে লিখতে পারেন, সে প্রমাণ তাঁর বহু রচনায়ই আমরা দেখতে পাই। একবার ভাবুন, ‘পরানের গহীন ভিতর’ কবিতাটির কথা। কী বিরাট তাঁর পাটাতন, কী বিস্তৃত তাঁর আয়োজন, কী গভীর তাঁর মানবিক অনুভূতি। যমুনা নদীর ভাঙন আর তাঁর কবিতার ‘গদ্যসম্পদ’ একাকার হয়ে গেছে এই দীর্ঘ কবিতায়। মানুষের ভালোবাসা, নারীর দুঃখ, স্বপ্ন, সংগ্রাম—সব কিছুই মিলে-মিশে সেকি ঐকতান। তিনি তাঁর সব রচনাকেই একই মহাস্রোতের অংশবিশেষ মনে করতেন। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটকে—এগুলোর আলাদা আলাদা কোনো অস্তিত্ব ছিল না তাঁর কাছে। এ সবই একই অঙ্গের নানা রূপ বলে তিনি মনে করতেন। আর মনে করতেন, এ সবগুলোরই উত্স হলো ভাষা। প্রিয় বাংলা ভাষা। যে ভাষাকে তিনি ভাঙেন, গড়েন আপন খেয়ালে। তিনি কবিতা লিখতেন জীবনের ‘পারসপেকটিভ’ বোঝার জন্য। বলতেন, ‘কবিতা আমার আকাশে উড়ার ডানা’। নাটকে ও উপন্যাসে তিনি মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে খেলতেন। এই সমাজের অসংগতি তুলে ধরতেন প্রবন্ধে। ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নাটকটির মূল বার্তা থেকেই বোঝা যায়, কত আগেই তিনি অনুমান করেছিলেন, পঁচাত্তর-পরবর্তী সমাজ কী দ্রুত বদলে যাচ্ছিল। ১৯৭৬ সালে লেখা এই নাটকের চরিত্রগুলো কতভাবেই না ধাবমান ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতাকে মোকাবেলা করে এগিয়ে নিতে হয়েছে। আর সেই মোকাবেলার মূল অস্ত্র ছিল মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনা। এই যুদ্ধ এখন আরো গভীর। আরো তীব্র।

‘প্রান্তজনে’ আমরা জানতে পাই এই প্রতিক্রিয়াশীলতা ও প্রগতির ধস্তাধস্তির মাঝ দিয়েই বেড়ে উঠেছেন সমকালীন সৈয়দ হক। ব্যক্তিজীবনেও তিনি ছিলেন ‘ফুল টাইম’ লেখক। না লিখলে তাঁর ভালো লাগত না। অবসরে আঁকতেন। আর প্রগতির পক্ষে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামের নেতৃত্বে চলে আসতেন।

এমন এক মানুষকে হারিয়ে বাংলাদেশ আসলেই অনেকটাই নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। রবীন্দ্রনাথ যেমন সমকালীন অন্যান্য কবি-সাহিত্যিককে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতেন, তেমনি আমাদের সৈয়দ হকও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন কবি আবুল হোসেন, শামসুর রাহমান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সাঈদ আতিকুল্লাহসহ প্রায় সবার প্রতি। তবে শামসুর রাহমানের প্রয়াণে তিনি দারুণ বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন। তাই লিখতে পেরেছিলেন ‘শামসুর রাহমান : আমার অশ্রুই আজ এ লেখার প্রতিটি অক্ষর’। লিখেছিলেন, ‘কবি তিনি আছেন ও থাকবেন, কিন্তু আমার সে বন্ধু আর নেই, আমাদের সহযাত্রী নেই। ’ মহান সতীর্থ শামসুর রাহমানের বিদায়ের সময় তিনি যেসব কথা লিখেছিলেন, তাঁর চলে যাওয়া নিয়েও তো একই কথা লেখা যায়। কবি তিনি আছেন থাকবেন, নাট্যকার তিনি আছেন থাকবেন, ঔপন্যাসিক তিনি আছেন থাকবেন। কিন্তু আমরা যে হারিয়েছি একজন অভিভাবককে, সহমর্মী সহযাত্রীকে। হারিয়েছি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী একজন সাহসী সৈনিককে। হারিয়েছি বঙ্গবন্ধুপ্রেমিক একজন সব্যসাচী সাহিত্যিককে। এই হারানোর ব্যথা কি এত সহজেই ভোলা যায়?

পোস্টটি আপনার স্যোশাল মিডিয়াতে শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরো সংবাদ
© All rights reserved © জীবন নিউজ ২৪ ডট কম
Theme Customized BY LatestNews