বেসিক ব্যাংকে নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা, বয়স, লিখিত-মৌখিক পরীক্ষা, নিয়োগ সংক্রান্ত বিধি-বিধান- কোনো কিছুই মানা হয়নি। রাষ্ট্রায়ত্ত এ ব্যাংকে স্থান হয়নি যোগ্য-মেধাবীদের। দুর্নীতি-অনিয়ম করে খেয়াল খুশিমতো নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যা অকল্পনীয়।
তবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের অর্থ কেলেঙ্কারির অভিযোগ তদন্ত করলেও নিয়োগ-দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত করছে না। এ ব্যাপারে দুদকের বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত বিভাগের পরিচালক কাজী সফিকুল আলম সমকালকে জানান, নিয়োগ-দুর্নীতি সংক্রান্ত সিএজির নিরীক্ষা প্রতিবেদন তাদের হাতে পৌঁছেনি। প্রতিবেদনটি পেলে নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে।
নিয়োগ সংক্রান্ত নীতিমালা লঙ্ঘন করে কোনো বিজ্ঞপ্তি ও লিখিত-মৌখিক পরীক্ষা ছাড়াই, এমনকি আবেদনপত্র জমা না দিলেও কিংবা জীবনবৃত্তান্তে স্বাক্ষর না থাকলেও অনেককে বেসিক ব্যাংকে চাকরি দেওয়া হয়েছে। উত্তরপত্র অতি মূল্যায়িত করে নম্বর দিয়েও চাকরি দেওয়া হয়েছে অদক্ষ, অনভিজ্ঞদের। শিক্ষাগত সনদে একাধিক তৃতীয় শ্রেণি থাকলেও কিংবা চাকরির বয়সসীমা পার হয়ে গেলেও নিয়োগ পেয়েছেন কেউ কেউ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেসিক ব্যাংকের এক পদস্থ কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, আবেদন করার আগেই নিয়োগপত্র দেওয়ার ঘটনা পৃথিবীর কোথাও নেই। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ঘরোয়া পরিবেশে লিখিত পরীক্ষা নিয়ে, উত্তরপত্রে কর্মকর্তার স্বাক্ষর না করে, জীবনবৃত্তান্তে স্বাক্ষর না করে, উত্তরপত্রে অতি মূল্যায়িত নম্বর দিয়ে নিয়োগ দেওয়া যায় না। অথচ এ ব্যাংকে এমনই ঘটেছে।
শিক্ষায় অযোগ্য, তবুও চাকরি হলো :সিএজির প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই সময়ে ব্যাংকটির সহকারী কর্মকর্তা (ক্যাশ) হিসেবে নিয়োগ পাওয়া মোছা. নাজমা খানম ১৯৮৭ সালে এসএসসিতে দ্বিতীয় শ্রেণি, ১৯৮৯ সালে এইচএসসি এবং ১৯৯১ সালে স্নাতকে তৃতীয় শ্রেণিতে পাস করেন। বিয়ে করার পর তিনি লোভনীয় বেতনে ওই পদে যোগ দেন। নিয়োগের সময় তার বয়স ছিল ৪০ বছর ২ মাস। অর্থাৎ চাকরির আবেদন করার ক্ষেতেই তিনি অযোগ্য ছিলেন। তার নিয়োগ সংক্রান্ত ফাইলে চাকরির আবেদনপত্রও খুঁজে পাননি নিরীক্ষক। জীবনবৃত্তান্তে নেই স্বাক্ষর। ঘরোয়াভাবে নামকাওয়াস্তে তৈরি করা লিখিত পরীক্ষার খাতায় ব্যাংকের সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তার স্বাক্ষর ও তারিখ নেই। নাজমা খানমের জন্ম ১৯৭২ সালের ১৬ জুন তারিখে। তিনি এ চাকরিতে যোগ দেন ২০১২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর।
৫২ বছর বয়সে চাকরি সাজেদুলের :প্রতিবেদনে বলা হয়, এসকে সাজেদুল হকের সহকারী কর্মকর্তা পদে যোগ দেওয়ার সময় বয়স ছিল ৫১ বছর ১১ মাস। ওই পদে যোগ দিয়েছিলেন ২০১২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। তার জন্ম তারিখ ১৯৬৩ সালের ২ অক্টোবর। ব্যাংক বা কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চাকরির অভিজ্ঞতা নেই তার। শিক্ষাগত যোগ্যতায় একাধিক তৃতীয় শ্রেণি। পরীক্ষার খাতায় কোনো কর্মকর্তার স্বাক্ষর নেই। চাকরির আবেদন ও জীবনবৃত্তান্ত ছাড়াই ঘরোয়া পরিবেশে লিখিত পরীক্ষা নিয়ে অতি মূল্যায়িত করে বেশি নম্বর দিয়ে কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় তাকে।
একদিনেই চাকরি শাহাদতের :চাকরির আবেদনপত্র জমা না দিয়েই অফিসার পদে মাত্র একদিনেই নিয়োগ পেয়েছেন মো. শাহাদৎ হোসেন। নামমাত্র একটি জীবনবৃত্তান্ত জমা দেন তিনি ২০১২ সালের ২৩ ডিসেম্বর। পরদিন তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। জীবনবৃত্তান্ত জমা নেওয়া, লিখিত পরীক্ষা নিয়ে ফল প্রকাশ ও নিয়োগ দেওয়া হয় একই দিনে। নিয়োগ সংক্রান্ত বিধি-বিধান না মেনে এভাবে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ৭৩১ জন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।
সাবেক এমডির সুপারিশে নিয়োগ ২৮ জনের :ব্যাংকের তৎকালীন এমডি কাজী ফখরুল ইসলামের সুপারিশে একই প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পান আরও ২৮ কর্মকর্তা। অফিসার পঙ্কজ চন্দ্র দাস ব্র্যাক ব্যাংক থেকে এসে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি যোগ দেন ২০১৩ সালের ২১ জুলাই। অথচ ব্র্যাক ব্যাংক থেকে তাকে ছাড়পত্র দেওয়া হয় ২০১৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। সাবেক ওই এমডির সুপারিশের দিনই কোনো যাচাই-বাছাই না করেই তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তার চাকরির বয়সসীমাও শেষ হয়ে গিয়েছিল।
কোনো যাচাই না করেই ২০১৩ সালের ৯ জুন এমডির সুপারিশের দিনেই সহকারী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেওয়া হয় সাদরিনা আইরিনকে। সহকারী কর্মকর্তা রাসেউল আযম জীবনবৃত্তান্ত জমা দিয়েছেন ২০১৩ সালের ২৪ জুলাই। তাকে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছে এর আগের দিন ২৩ জুলাই। এমডির সুপরিশে এভাবেই ২৮ কর্মকর্তা নিয়োগ পান।
বিজ্ঞপ্তির আগেই ১৩ কর্মকর্তাকে নিয়োগ :সিএজির প্রতিবেদনে বলা হয়, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই বেসিক ব্যাংকে নিয়োগ দেওয়া হয় ১৩ জনকে। আবেদনপত্র পেশের আগেই তাদের নিয়োগপত্র দেওয়া হয়। এর মধ্যে তানিয়া সুলতানা জীবনবৃত্তান্ত জমা দেন ২০১৪ সালের ৪ এপ্রিল। তাকে নিয়োগপত্র দেওয়া হয় এক মাস আগে একই বছরের ২৭ মার্চে! এ ছাড়া সহকারী কর্মকর্তা মো. জহিরুল হক, মাহফুজা বেগম, আমিনুর রহমান, সোগাহ হাজরা, রনজিত রায়, মনোয়ারা খাতুন, মহিদুল ইসলাম, এমএম কাইয়ুম হাসান, আয়োতি নাহার, মো. নিজাম মিয়া, সালমা আকরাম ও শনিতা ইয়াসমিনকে আবেদনপত্র পেশের আগেই নিয়োগপত্র দেওয়া হয়।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, একই প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেওয়া হয় আরও ২৯ জন জুনিয়র অফিসারকে।
অফিস সহকারী, গার্ড, পত্রবাহক ও গাড়িচালক ৩৭২ জন :ওই সময় নিয়োগ সংক্রান্ত নীতিমালা অনুসরণ না করে যেমন খুশি তেমনভাবে মনগড়া তথাকথিত স্কাউটিং পদ্ধতিতে ২৮৭ জন গার্ড, মেসেঞ্জার, ৬৯ জন গাড়িচালক ও ১৬ জন অফিস সহকারীকে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে তাদের ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের শাখায় নিযুক্ত করা হয়।
পদোন্নতিতে অনিয়ম-দুর্নীতি :নিয়োগবিধি ও দক্ষতা অনুযায়ী পদোন্নতি দেওয়ার কথা থাকলেও সাবেক চেয়ারম্যান বাচ্চুর সময় ২২ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয় নিজেদের খেয়ালখুশি মতো। এমন একজন ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) কনক কুমার পুরকায়স্থ। পদোন্নতির নীতিমালা না মেনে তাকে জিএম পদে ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর ও ডিএমডি পদে ২০১১ সালের ১০ মে পদোন্নতি দেওয়া হয়। নিয়মানুযায়ী, জিএম পদে তিন বছরের চাকরির অভিজ্ঞতাসহ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে ২৫ বছর চাকরির বয়স হলে ডিএমডি পদে পদোন্নতি দেওয়া যায়। অথচ তিনি জিএম পদে ছিলেন মাত্র এক বছর ছয় মাস ২০ দিন। এ সময় তিনি কোনো কৃতিত্বপূর্ণ অবদানও রাখেননি।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, তখনকার ব্যাংক কর্তৃপক্ষ স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নিয়ে পছন্দের কয়েকশ’ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অতিরিক্ত বেতন-ভাতা দিয়েছে।
কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর থেকে ২০১৩ সালে বেসিক ব্যাংকের নিয়োগ-পদোন্নতি নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি নিরীক্ষা করা হয়। নিরীক্ষাকালে ২০১৩ সালের আগের বছর ও পরের বছরের নিয়োগ-পদোন্নতির তথ্য খতিয়ে দেখা হয়। শেখ আবদুল হাই বাচ্চু ২০০৯-১৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত দুই মেয়াদে ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। তখন ব্যাংক থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়। অর্থ আত্মসাতের এ ঘটনার তদন্ত করছে দুদক।
সিএজি সূত্র জানায়, বাচ্চুর দুই মেয়াদে সব রকম নিয়োগ সংক্রান্ত অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ উঠে এসেছে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে। বাচ্চুর সময়ে ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ লোপাটের পাশাপাশি নিয়োগ, পদোন্নতির ক্ষেত্রে দুর্নীতি ভয়াবহ রূপ পায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিএজির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, বাচ্চুর নির্দেশনা অনুযায়ী চাকরিপ্রাপ্তদের কাছ থেকে মোটা অংকের উৎকোচ নিয়ে এক হাজার ১৭৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ওই এক হাজার ১৭৩ জনের মধ্যে কর্মকর্তা ৮০১ জন, অফিস সহকারী, গার্ড, পত্রবাহক ও গাড়িচালক ৩৭২ জন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালের শুরুতে বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। অনুসন্ধানের পর ৫৬টি মামলা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক পরিচালক সমকালকে বলেন, নিয়োগ-পদোন্নতিতে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগটি সম্পর্কে তিনি জানেন না। অভিযোগটি তার কাছে উপস্থাপন করা হয়নি। কমিশনে এসে থাকলে দেরিতে হলেও সেটির অনুসন্ধান হবে। এক প্রশ্নের উত্তরে এই কর্মকর্তা বলেন, কমিশনে কোনো অভিযোগ এলে সেটা গোপন করার সুযোগ নেই।