ইনিংস ব্যবধানে বাংলাদেশ আগেও হেরেছে। দৃষ্টিকটু ব্যাটিং ব্যর্থতা কিংবা আড়াই দিনের মধ্যে হারও নতুন কিছু নয়। যে কারণে দেশের ক্রিকেট কাঠামোর দুর্বলতা, টেস্ট খেলার স্বল্পতা, প্রতিপক্ষের শক্তি, নিজেদের সীমাবদ্ধতা কিংবা অচেনা গোলাপি বলের কথাই আসছে ঘুরেফিরে। কিন্তু ভারতের মাটিতে দুই টেস্টের সিরিজে এসবের বাইরেও নতুন কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে বাংলাদেশ, যে প্রশ্নের উত্তর বা সমাধান দরকার দ্রুতই
-অধিনায়ক কেন একা
সাকিব আল হাসান নেই নিষেধাজ্ঞায়, তামিম ইকবাল নেই পারিবারিক ব্যস্ততায়। এ দু’জন শুধু দলের সেরা পারফরমারই নন, অন্যতম অভিজ্ঞও। তারা না থাকায় সিনিয়র ক্রিকেটার বলতে মুশফিকুর রহিম, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, ইমরুল কায়েস আর মুমিনুল হক। আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকায় দলীয় কর্মকাণ্ডে ইমরুলের ভূমিকা সামান্য। অধিনায়ক মুমিনুলকে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতার দায়িত্বটা বেশি ছিল তাই মুশফিক-মাহমুদুল্লাহর। এ দু’জনের আবার নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতাও আছে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সহযোগিতা কি পেয়েছেন প্রথমবার অধিনায়কত্ব করতে নামা মুমিনুল? মাঠের খেলায় যারা চোখ রেখেছেন, এক শব্দে তাদের উত্তর হবে- ‘না।’
ফিল্ডিংয়ের সময় অধিনায়কের সঙ্গে মুশফিক-মাহমুদুল্লাহকে কথাই বলতে দেখা যায়নি খুব একটা। অথচ একজন বিরাট কোহলির সঙ্গে বোলিং পরিবর্তন বা ফিল্ডিং সেটআপ নিয়ে নিয়মিতই কথা বলতে দেখা গেছে অশ্বিন, রোহিতদের। মুমিনুলের একলা নাবিক হয়ে পড়ার দৃশ্য এতটাই স্পষ্ট ছিল যে ভারতীয় কিংবদন্তি সুনীল গাভাস্কারও এ নিয়ে সমালোচনায় মেতেছেন, ‘বাংলাদেশ দলে দুইজন সিনিয়র ক্রিকেটার ছিল। নতুন অধিনায়ককে তারা কোনো সহযোগিতাই করেনি। তাকে একবারও গিয়ে কেউ কোনো পরামর্শ দিল না। এই নিবেদনটা তাদের কাছ থেকে দেখা যায়নি। এটা হতাশারই বটে।’
-ম্যানেজমেন্টের উদাসীনতা
দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম দিনেই কনকাশনে মাঠ ছাড়তে হয়েছে লিটন দাস ও নাঈম হাসানকে। ‘লাইক ফর লাইক’ নিয়মে তাদের বদলি নামাতে গিয়ে দেখা গেল, খেলোয়াড়ই নেই বাংলাদেশ দলে। লিটনের জায়গায় একজন ব্যাটসম্যান নামানোর দরকার হলেও নিরুপায় হয়ে অফস্পিনার মিরাজকে ব্যাটিংয়ের জন্য পাঠাতে হয়েছে। পরে নাঈমের বদলি হিসেবে তাইজুলকে নামানোর পর দেখা গেল, মাঠের ভেতর পানির বোতল-তোয়ালে পাঠানোরই কেউ নেই। কারণ, ১৩ ক্রিকেটার ম্যাচের মধ্যে ঢুকে পড়ায় কারও জরুরি প্রয়োজনে বদলি ফিল্ডার হিসেবে খেলানোর জন্য আছেন কেবল মুস্তাফিজ। এখন মুস্তাফিজকে বদলি ফিল্ডিংয়ে নামালে পানি নেওয়ার কেউ নেই, পানি নিয়ে পাঠালে বদলি ফিল্ডিংয়ের কেউ নেই।
অগত্যা চোটাক্রান্ত সাইফ হাসানকে পাঠাতে হয়েছে বোতল-তোয়ালে দিয়ে। কলকাতা টেস্ট শুরুর দু’দিন আগেই আঙুলের চোটে ম্যাচ থেকে ছিটকে যান সাইফ। তারও আগে পারিবারিক কারণে টি২০ খেলেই দেশে ফেরেন মোসাদ্দেক হোসেক। টেস্ট স্কোয়াডে থাকা এ দুই ক্রিকেটার দ্বিতীয় টেস্ট শুরুর দু’দিন আগেই বাদ পড়ে গেলেও আধা ঘণ্টা দূরত্বের ঢাকা থেকে কোনো বদলি খেলোয়াড় পাঠানো হয়নি। কনকাশনের ঘটনা আগাম অনুমান করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়, সেদিক থেকে দু’জনের ছিটকে পড়া দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু কনকাশন বাদে ম্যাচের আগের দিন বা ম্যাচের দিন সকালেও যদি কেউ অনুশীলনে নেমে চোটে ছিটকে যেতেন, তখন কীভাবে একাদশ সাজাত টিম ম্যানেজমেন্ট? এগারোজনের খেলায় পনেরোজনের স্কোয়াড কী কারণে করা হয়, সেটি কি দুই দশক টেস্ট খেলা দলের ম্যানেজমেন্ট ভুলে গিয়েছিল?
-গা বাঁচিয়ে চলা
কিপিং গ্লাভস স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলার জন্য। সেই স্পেশালিটি কাজে লাগানোর জন্য তিন বা চার নয়, পাঁচ নম্বর পজিশন বেছে নিয়েছেন মুশফিকুর রহিম। ইন্দোরে প্রথম টেস্টের সময়ই তার পরের দিকে নামা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু কলকাতা টেস্টেও দেখা গেল একই হাল। পাঁচে খেলছেন মুশফিক। এটা ঠিক যে টেস্টে চারের চেয়ে পাঁচেই তার রান বেশি। কিন্তু ওয়ানডে-টি২০ ফরম্যাটে নিয়মিত চারে খেলা মুশফিক কি টেস্টেও দায়িত্বটি নিতে পারতেন না?
প্রতিটি ইনিংসেই মিঠুন নামলেন তার আগে এবং আউটও হলেন দ্রুত। দলের বিপর্যয় সামাল দেওয়ার চ্যালেঞ্জটি কেন নিলেন না টেকনিক্যালি দলের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে আখ্যায়িত মুশফিক? ধারাভাষ্যকার হার্শা ভোগলে তাই রাখঢাক না রেখেই বলেছেন, পাঁচ নম্বরে হয়তো ব্যাটিংয়ের ‘বেস্ট’টা দিতে পারে, কিন্তু দলের জন্য কি তা ‘বেস্ট’ হলো? প্রশ্নটা কি গা বাঁচিয়ে খেলার দিকে আঙুল তুলছে না?
-এবং সহমর্মিতা…
এটি প্রশ্ন নয়, নিজেদের অসহায়ত্বের নিদারুণ প্রকাশ। ভারতের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে বাংলাদেশ দল যে পারফরম্যান্সে, মানসিকতায় আর নিবেদনে কতটা বঞ্চিত করেছেন দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের, সেটি ভেবে সহমর্মিতা জানিয়েছেন ভারতের সুনীল গাভাস্কার। গতকাল বাংলাদেশ দল প্রসঙ্গে বলা নানা কথার মধ্যে একটি ছিল এ রকম, ‘বাংলাদেশের সমর্থকদের জন্য আমার দুঃখ হয়। ক্রিকেটে অন্যতম আবেগপ্রবণ সমর্থক তারা। সত্যি সত্যিই দলকে এবং ক্রিকেটারদের ভীষণ ভালোবাসে। কিন্তু এ দুই ম্যাচে ক্রিকেটাররা যা করেছে, তা এই সমর্থকদের প্রাপ্য ছিল না!’